বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও শিল্পী সম্মানী প্রসঙ্গে

কামরুজ্জামান লিটন

বাংলাদেশ বেতার দেশের সর্ববৃহৎ গুরুত্বপূর্ণ গণপ্রচার মাধ্যম। ১৯৭১ এর জাতীয় মুুক্তিযুদ্ধসহ সবসময়ই বেতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাংলাদেশ বেতারকে প্রদান করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মানের স্বাধীনতা পদক।

বিসিএস তথ্য ক্যাডারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা বাংলাদেশ বেতার পরিচালিত হলেও এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে দেশের শিল্পী সমাজ। সংগীত শিল্পী, নাট্যশিল্পী, সংবাদ পাঠক, উপস্থাপক, কথিকা পাঠক, গীতিকার এবং নাট্যকার বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পী এবং লেখকদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়। দেশের তৃণমূল পর্যায়ের কোটি কোটি মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যমই হচ্ছে বেতার। বেতারের অনুষ্ঠান শুধু বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণসচেতনতা, দূর্যোগকালীন সময়ে আবহাওয়ার সংবাদ ও বুলেটিন প্রচার, এছাড়া দৈনন্দিন প্রত্যেক ঘন্টায় ১০ অথবা ৫ মিনিটের সংবাদ এছাড়াও রয়েছে ক্রীড়া সংবাদ, ক্রীড়া বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বেতার জনপ্রিয় প্রচার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

বেতারের বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানও শ্রোতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এ সকল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে সংগীত, ক্রীড়া, বিশ্বে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ও চমকপ্রদ ঘটনার আলোচনা, নাটিকা, কুইজ অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয় শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে থাকে।

বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন তাদের জন্যে রয়েছে বহির্বিশ্ব কার্যক্রম। এছাড়া বেতারের রয়েছে বিভিন্ন প্রচার কেন্দ্র। এগুলো হচ্ছে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল কেন্দ্র। এ কেন্দ্রগুলোতে নিজস্ব অনুষ্ঠান প্রচার ছাড়াও ঢাকা বেতার থেকে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো ও জাতীয় সংবাদ একযোগে সব কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়ে থাকে। আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো ছাড়াও বেতারের আরও রয়েছে কৃষি বিষয়ক কার্যক্রম, ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস এবং জনসংখ্যা কার্যক্রম।

বাংলাদেশ বেতারের গুরুত্বপূর্ণ শ্লোগান হচ্ছে ‘বেতার সবসময় সবার পাশে’। বাংলাদেশ বেতারের সমৃদ্ধিতে যারা ভূমিকা রাখছেন প্রতিনিয়ত তাদের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে, কন্ঠ দিয়ে, সৃজনশীলতা দিয়ে যারা তিলে তিলে সমৃদ্ধির সোনালী সোপানে বাংলাদেশ বেতারকে পৌছে দিয়েছেন তারা বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী এবং অল্প কিছু সংখ্যক স্টাফ আর্টিস্ট। এই স্টাফ আর্টিস্টরা স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারী বেতনভুক্ত। তারা সরকারী চাকুরি বিধিমালা অনুযায়ী বেতন ও সুযোগ সুবিধাদি পেয়ে থাকেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যুগ যুগ ধরে বেতারের তালিকাভুক্ত নিয়মিত শিল্পী অথবা অনিয়মিত শিল্পী যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং তারা শিল্পী হিসাবে যে সম্মানী পেয়ে থাকেন তা সম্মানজনক যেমন নয় তেমনি শিল্পীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ বেতারের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পীদের সম্মানী খুবই কম যা নুন্যতম সম্মানীও নয়।

বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শিল্পীদের যে শিল্পী সম্মানী প্রদান করা হয় তা হচ্ছে সংগীত শিল্পীদের বিভিন্ন গ্রেডের মধ্যে সর্বোচ্চ বিশেষ শ্রেণীর শিল্পীরা ১০ মিনিটে অর্থাৎ দুটি গান পরিবেশন করে সম্মানী পান ২ হাজার টাকা, ক শ্রেণীর শিল্পীরা পান ১৬০০ টাকা, খ শ্রেণীর শিল্পীরা পান ১১০০ টাকা এবং গ শ্রেণীর শিল্পীরা পান ৬২৫ টাকা। এছাড়া নাট্যশিল্পীরা ক শ্রেণীতে পান ১৫০০ টাকা শিল্পী সম্মানী এবং মহরত ৫০০ টাকা, খ শ্রেণীতে পান ১১৫০ টাকা ও মহরত ২০০ টাকা, গ শ্রেণীর নাট্যশিল্পীরা শিল্পী সম্মানী পান ৫০০ টাকা এবং মহরত ১০০ টাকা। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপকরা পান সর্বসাকুল্যে ৫০০ টাকা। এছাড়া ক শ্রেণীর সংবাদ পাঠকরা ১০ মিনিটের সংবাদে সম্মানী পান ৫০০ টাকা, খ শ্রেণীরা পান ৪০০ টাকা এবং গ শ্রেণীর সংবাদ পাঠক পান ৩৫০ টাকা। এছাড়া নাট্যকাররা বেতারের সর্বোচ্চ সময় স্থিতিকালের অর্থাৎ ৫৫ মিনিটের নাটক লিখে সম্মানী পান ৮ হাজার ২ শত ৫০ টাকা, খ শ্রেণীর নাট্যকাররা পান ৭ হাজার ১ শত ৫০ টাকা, গ শ্রেণীর নাট্যকাররা পান ৪ হাজার ১ শত ২৫ টাকা। তবে নাট্যকাররা নাটক পুনঃপ্রচারের সম্মানী পেয়ে থাকেন। ক শ্রেণীর গীতিকাররা ১টি গান ১ বার প্রচারে ৫০ টাকা, খ শ্রেণীতে পান ৩০ টাকা এবং গ শ্রেণীতে ২০ টাকা। গীতিকাররাও তাদের লেখা গান পুনঃপ্রচারে রয়্যালিটি পদ্ধতিতে সম্মানী পেয়ে থাকেন।

এ যাবৎকালে বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী সম্মানী দ্বিগুণ ও চারগুণ বৃদ্ধির ব্যাপারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে শিল্পীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা গেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিল্পীদের কাক্সিক্ষত সম্মানী কখনো অর্জিত হয়নি। দ্বিগুণ, চারগুণ শিল্পী সম্মানী বৃদ্ধির বিষয় নয়, প্রকৃতপক্ষে শিল্পীদের সম্মানী এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত যা শিল্পীদের জীবনযাত্রার সাথে সংগতিপূর্ণ।

বেতারের শিল্পীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত, তারা আশাবাদি যে, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেতারের সম্মানীত শিল্পীদের সম্মানী উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি করবেন, যেমন তিনি দেশের অন্যান্য পেশাজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন।

কামরুজ্জামান লিটন: লেখক ও গবেষক

Print Friendly

Related Posts