পর্যটন শিল্প বিকাশে নড়াইল

মো. হাবিবুর রহমান

চিত্রা, মধুমতী, নবগঙ্গা, আফরা, কাজলাসহ সাতটি নদী বেষ্টিত, শতাধিক খাল এবং কয়েকটি বড় বড় বিলে সমৃদ্ধ নড়াইল জেলার রয়েছে ব্রিটিশ আমলের তেভাগা আন্দোলন ও নীল বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণের ইতিহাস এবং দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়ানোর বীরত্বগাথা। ক্রীড়া-সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধের জেলা হিসেবে পরিচিত নড়াইলে আগমন ঘটেছিল অসংখ্য আধ্যাত্মিক সাধক, ফকির, দরবেশ ও ধর্মপ্রচারকদের।

এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন বর্তমান সময়ের অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক, রাজনৈতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও ক্রীড়াবিদ। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান, জারি সম্রাট মোসলেম উদ্দিন, চারণ কবি বিজয় সরকার, উপমহাদেশের বিখ্যাত সেতার বাদক রবি শংকর, নৃত্য শিল্পী উদয় শংকর, কথাসাহিত্যিক ড. নীহার রঞ্জন গুপ্ত, সুরকার কমল দাশগুপ্ত, ক্রীড়া জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং নড়াইল-২ সংসদীয় আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মোর্তজার জন্মস্থান এই নড়াইল।

প্রায় সাড়ে সাত লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৯৯০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা নড়াইল; মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হয় ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। জেলা হিসেবে আত্মমর্যাদা লাভের পর পরই অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার নিয়ে নড়াইল বর্তমান সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। একসময় এ জেলাকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনগ্রসর হিসেবে অনুমান করা হলেও বর্তমান সময়ে ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নড়াইলকে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার কানেক্টিং হাবের মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করতে বর্তমানে যশোর-নড়াইল-কালনা সড়ক, নড়াইল-কালিয়া সড়ক, নড়াইল-মাগুরা সড়ক, নড়াইল-ফুলতলা সড়ক, লোহাগড়া-মহম্মদপুর সড়কের উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে।

পদ্মা সেতু এবং কালনা সেতু নির্মাণের ফলে নড়াইল জেলা এশিয়ান হাইওয়েতে প্রবেশ করে খুলনা বিভাগের উদীয়মান জেলা হিসেবে তার সম্ভাবনাময় খাতগুলো বাস্তবে রূপান্তর করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব হবে মাত্র ১২০ কিলোমিটার বা বলা যায় রাজধানী থেকে সময়ের ব্যবধান হবে মাত্র ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। অন্যদিকে এখান থেকে বেনাপোল স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র ৭৪ কিলোমিটার বা ১ ঘণ্টা। নড়াইলের ওপর দিয়ে ২৮ কিলোমিটার পদ্মা রেল সংযোগ সেতু নির্মাণের পাশাপাশি নড়াইল সদর ও লোহাগড়া উপজেলায় রেলস্টেশন নির্মাণ কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। ঢাকা-কলকাতা ট্রেন যাতায়াত এ জেলার ওপর দিয়েই হবে। সড়ক, নৌ ও রেলপথের উন্নয়ন যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থের সাশ্রয় করবে; যা শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন প্রাপ্তির পর এ সম্ভাবনা আরো দৃঢ় হয়েছে। এমনকি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিসিক শিল্পনগরীর প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এরই মধ্যে শিল্পবান্ধব জেলা হিসেবে পরিচতি লাভের ফলে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান শিল্প-কারখানা স্থাপন শুরু করেছে। অনেকেই শিল্প-কারখানা নির্মাণে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন।

কৃষি ক্ষেত্রে নড়াইল সমৃদ্ধ স্থানে থাকায় নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, বিশেষত নড়াইলে প্রচুর পাট ও গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। কাঁচামালের সহজলভ্যতার কারণে এখানে জুট মিল ও মাছ সংরক্ষণ ব্যবস্থা করাসহ উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। এসব বাস্তবায়িত হলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ রফতানি আয়বর্ধক জেলা হিসেবে নড়াইল নবমাত্রায় রূপ পাবে এবং এ অঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটবে।

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো আধুনিকায়নের ফলে নড়াইলের আরেকটি সম্ভাবনা নতুন করে হাতছানি দিয়েছে। তা হলো পর্যটন শিল্পের বিকাশ। সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী নড়াইলে রয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মুসলিম শাসন আমলের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ও প্রাচীন কারুকাজের নির্মাণশৈলীর মন্দির। জোয়ার-ভাটার চিত্রা নদীর তীরে অবস্থিত নড়াইলের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুলতান কমপ্লেক্স, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ কমপ্লেক্স, বাঁধাঘাট, হাটবাড়িয়া জমিদার বাড়ি, নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের বাড়ি, নীহার রঞ্জন গুপ্তের বাড়ি, কমলদাশ গুপ্তের বাড়ি, পণ্ডিত রবি শংকরের আদি নিবাস, ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির শ্বশুরবাড়ি, ঐতিহাসিক গোয়াল বাথান মসজিদ, সর্বমঙ্গলা কালীবাড়ি মন্দির, শ্রী শ্রী দশ অবতার এবং মনসা দেবীর মন্দির, শ্রী শ্রী সর্বজনীন দেবত্ত মন্দির ও নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাবিশেষ। আধুনিক বিনোদনের জন্য রয়েছে অরুনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব, স্বপ্নবীথি পিকনিক স্পট , নিরিবিলি পিকনিক স্পট, চিত্রা রিসোর্ট এবং নৌভ্রমণের সুব্যবস্থা। নাগরিক জীবনের চাহিদা এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হাটবাড়িয়া জমিদার বাড়ি ডিসি পার্ক নির্মাণ, বাঁধাঘাট দৃষ্টিনন্দনকরণ, সুলতান ঘাট নির্মাণ, এসএম সুলতান কমপ্লেক্স আধুনিকায়নসহ জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত ও বিশ্বমানের করার মাধ্যমে নড়াইলকে পর্যটন সম্ভাবনাময় জেলায় পরিণত করার জন্য জেলা প্রশাসন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

অবকাঠামো উন্নয়ন, দেশীয়-আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পর্যটন ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে জেলা প্রশাসন সর্বদা সচেষ্ট আছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে নির্মল চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আহরণের সঙ্গে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বোপরি পর্যটনকেন্দ্রিক এ উন্নয়ন হবে টেকসই উন্নয়ন।

রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে এবং উন্নত সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে প্রতিটি নাগরিকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আত্মো উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নড়াইল জেলার সম্ভাবনাময় সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও দর্শনীয় স্থানগুলোকে আরো বিকশিত এবং আক্ষরিক রূপ দেয়ার জন্য কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে দরকার সমাজের সব স্তরের সমন্বিত অংশগ্রহণ, সুচিন্তিত মতবাদ এবং কার্যকর ভূমিকা।

লেখক: জেলা প্রশাসক, নড়াইল।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts