মানবিক ও কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য

ম্যাকি ওয়াদুদ

আমাদের সমাজে মানুষগুলো নিজেকে একজন ব্যক্তি হিসেবে বড়ই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। মানুষ হিসেবে নয়। ব্যক্তির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত নিজের ব্যক্তিত্ব। আর মানুষের সাথে মনুষত্ব। ব্যক্তিত্ব শুধুই স্বার্থপরতা ও অহংকার আর মনুষত্ব হলো একজন ব্যক্তি বিশেষের অলংকার যা আমৃত্যু একজন মানুষকে দান করে অমরত্ব।

আমাদের এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে যাদের ধনসম্পদ আর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা আছে তারাই ব্যক্তি। তাদেরই আছে ব্যক্তিত্ব। আর যে ব্যক্তিগুলো মানুষের সহযোগিতা ও দয়াদাক্ষিণ্যে বাঁচে তাদের ব্যক্তিত্ববোধ তো নেই-ই তবে তারা মানুষও হতে পারেনা। গরীব ও সৃষ্টিশীল মানুষগুলো সমাজের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। তাদের সৃজনশীলতা ও অধিকারবোধ গুলিও যেন নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের সমাজ ও পরিবারের তথাকথিত নীলক্ষত রক্তচক্ষু ব্যক্তিবর্গ। তাদের কথায় চলে পরিবার আর তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র। যদি এমনই হয় তাহলে তো নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করে সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষ গুলো স্রষ্টার সৃষ্টি নয়। গরীব ও অবহেলিত মানুষগুলোকে সৃষ্টি করেছে আমাদের পরিবার ও সমাজ এবং রাষ্ট্র।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব ও আশরাফুল মখলুকাত বলে কথিত আছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমুহে। প্রকৃতিতে দৃশ্যমান অন্যান্য প্রাণীকূলের চাইতে মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা বিশেষ করে মনোজগৎ, আচার-আচরণ ও চালচলন এবং বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে। মানুষ যা ধারণ-লালন করে বা ভাবে তা অন্য জীবজন্তুর পক্ষে কখনো সম্ভবপর নয়। তাইতো মানুষের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য গুলিই আলাদা করে রেখেছে অন্য পশুপাখি ও উদ্ভিদ-বৃক্ষকূল থেকে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একজনের থেকে আরেকজনের শারিরীক গঠন, অবয়ব ও মন-মানসিকতা পৃথক করে সৃষ্টি করেছেন। তাইতো মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও ভাবনাচিন্তা ও চালচলন সম্পুর্ন আলাদা। মানুষের আকাঙ্খা ও চাহিদা এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোন শেষ নেই যা অসীম। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছে স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টির সেবাকরণের জন্যে ছোট্ট একটা জীবনকাল দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু এই দুনিয়ায় মনুষ্যজগতের আয়ুষ্কাল কত বছর তার কোন সীমানা নেই। যখনতখন মানুষের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে অসীমের পথে যাত্রা করতে পারে। তাইতো এই দুনিয়ায় মানবজীবনের দৈর্ঘ্য পুলসেরাতের পুলের সমান। তবুও মানুষের মধ্যে হীনমন্যতা, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা দেখে মনে হয় মনুষ্যজাতি এই নরকগুজার পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করবে বা পৃথিবীতে কোন মৃত্যু নেই।

সৃষ্টিকর্তা সমস্ত বিশ্বভ্রমাণ্ড সৌরজগত, চাঁদ, সূর্য, বৃক্ষরাজি, প্রকৃতি, প্রাণীকূল সমস্ত কিছু অপার রহমতে সৃষ্টি করছেন। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রতি একশ বছর পর প্রকৃতিতে নেমে আসে ভয়ংকর মহামারী, বিপদ ও মুসিবত। প্রকৃতিগতভাবে মানবকূলের মধ্যে সুখদুখ, ভালোমন্দের মধ্যে একটি সুষম অবস্থা বিরাজের জন্য এই মুসিবত সংগঠিত হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।

এই ভয়ঙ্কর বিপদ বা মহামারি হতে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের আপমায় জনগোষ্ঠীর উচিৎ ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা এবং সকলকে একসাথে মিলেমিশে স্রষ্টার ইবাদত বন্দেগী ও সেবা করা। স্রষ্টার সন্তুষ্টি আদায়ের লক্ষে যার যার জাতিগত ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা এনং মানুষের উপর পারস্পরিক জুলুম-অত্যাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, নৈরাজ্য শোষণ ব্যভিচার বন্ধ করে একাগ্রচিত্তে খোদার দাসত্ব স্বীকার করা। সকল সৃষ্টির প্রতি মহানুভব হয়ে একে অপরের পাশে থেকে সবাই একসাথে বিপদে ধৈর্য ধারণ করে মোকাবিলা করলে প্রকৃতি সজীব ও সুরভিত হবে এবং স্রষ্টার অপার রহমতে সকল মুসিবত দূর হতে পারে।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে প্রাণ ও মনের সুষম সমন্বয়ের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন তাঁর সৃষ্টি সকল বস্তু ও প্রাণীজগতকে অর্থাৎ বিশ্বভ্রমান্ড প্রকৃতিরাজিকে ভালোবেসে বেঁচে থাকতে। এবং স্রষ্টার প্রতি প্রেমোসিক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে তাঁর সেবা ও ইবাদতে মধ্যে মশগুল থাকতে। আর এই প্রাণটি রয়েছে বিবেকের মধ্যে আর মনটি রয়েছে আবেগের মধ্যে। একজন মানুষ যদি স্রষ্টার অপার সৃষ্টি দুইটি দিক প্রাণ ও মনের মধ্যে সমগুরুত্ব ও মর্যাদা দিতো তাহলে এই তাবৎ দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠি একটি ভাতৃত্ববোধ ও মানবিক এবং আধ্যাত্বিক সাধনায় প্রেমোদ্বিপ্ত হয়ে পৃথিবীতে সুখশান্তির স্বর্গ রচনা করতে পারতো। অথচ নরক-গুজার এই দুনিয়াতে আমরা প্রেম-ভালোবাসা বলতে বুঝি শুধু পুরুষের প্রতি নারীদের আকর্ষণবোধ একটি নারীর প্রতি পুরুষের অথবা পুরুষের প্রতি পুরুষের বা নারীর প্রতি নারীর অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ব্যক্তির প্রেম ভালোবাসা। আর এই নারীপুরুষের প্রেমভালোবাসা খেলা যদি সমগ্র মানবগোষ্ঠির প্রতি সমান ভালোবাসা ও সম্মান থাকতো তাতেও দুনিয়াতে শান্তি-সুখ বলতে কিছু থাকতো। এখন মানুষ শুধু ভালোবাসছে আর প্রেমসিক্ত হচ্ছে নিজের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে।

মানুষ যদি স্রষ্টাকে ভুলে যায় বা খোদার বশ্যতা স্বীকার না করে তাহলে খোদার সৃষ্টি এই দুনিয়ায় বিভিন্ন রোগশোক, কোভিড-১৯ মহামারী, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরারে মতো মানববিধ্বংসী আপদ আসবেই। সমস্ত অকল্যাণ ও বিপদ আপদ থেকে মানবকূল রক্ষা পেতে হলে খোদার প্রেমে আসক্ত হতে হবে এবং এবং নিজেকে নাচিজ মনে করে একাগ্রচিত্তে ইবাদত বন্দেগি করতে হবে। তাতেই স্রষ্টার সৃষ্ট মানুষের মধ্যে প্রাণ ও মননের সঠিক ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এবং খোদার অপার রহমতে সকল আপদ-বিপদ, বালা-মুসিবৎ ও দূঃখ-কষ্ট থেকে। মানুষ মুক্তি পাবে এই জগৎ-সংসারে ও অসীম-পরকালে।

সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষ তাদের বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেদের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন পরিবার ও সমাজ এবং রাস্ট্র। তবু আমরা স্রস্টার আদেশ নিষেধ ভুলে গিয়ে হয়েছি সমাজের কাছে জিম্মি। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি মানবিক হতো! হতো যদি আমাদের সমাজ আপময় জনসাধারনের তবে আমাদের দূঃখ বা কষ্ট থাকতোনা। আমরা যে সমাজে বাস করছি তা শুধু টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাবান মানুষের জন্য। যেখানে পশ্চাৎপদ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কোন মূল্য নেই। নেই কোন মর্যাদা ও অধিকার। তাদের সৃজনশীলতা ও কষ্টদুঃখের কোন মূল্যায়ণ নেই আমাদের এই ক্ষয়িষ্ণু ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থায়।

পৃথিবীর মানুষগুলি সুশৃঙ্খলভাবে জীবন ধারণ ও জীবিকা লাভের জন্য পরিবার প্রথার প্রচলন হয়েছে। পরিবার বলতে বুঝি আমরা মা-বাবা, ভাইবোন ও দাদা-দাদী, ফুফু-চাচাসহ সবাই মিলেমিশে একত্রিত হয়ে বাস করাকে বুঝায়। এদেশে স্বাধীনতার পূর্বে বেশীর ভাগ যৌথ পরিবার প্রথার চল থাকলেও কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। এখন পরিবার বলতে আমরা বুঝি শুধু মা-বাবা ও ভাইবোনের মধ্যে সীমিত। পরিবারের একজন সন্তান বিয়ে করে যখন সংসার সুচনা করে তখন তার কাছে পরিবার হলো শুধুই স্বামী-স্ত্রী একসাথে মিলেমিশে থাকা। যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমাদের মনুষ্য জগতের জীবন ও জীবিকার ভাবনায় এসেছে অনেক পট-পরিবর্তন। যা আমাদেকে ব্যক্তিস্বার্থ ব্যতিত সামষ্টিক ভাবনায় মনোভাব পোষণের ক্ষেত্রে অন্তরায়।

আমরা খুব ছোটবেলা থেকে পরিবারের বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-ফুফু ও আত্মীয় স্বজন এবং পারিপার্শ্বিক সমাজের প্রতিবেশীদের আচার-আচরণ, রীতিনীতি, জীবনাদর্শ ও শিক্ষা সংস্কৃতি জাতকৃষ্টি ও ঐতিহ্য তথা পারিবারিক রীতিনীতি দেখে বুঝে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকি। এই বিষয়গুলি থেকেই আমাদের জীবন ও জীবিকা পরিচালনার জন্য যোগ্যতা ও মানসিকতা তৈরি হয়। যা আমরা ব্যবহার করি সমাজ ও রাষ্ট্রে একজন নাগরিক হয় বসবাস করার ক্ষেত্রে। মূলত পারিবারিক শিক্ষাটুকুই একজন মানুষকে সমাজে ও রাষ্ট্রে সুনাগরিক ও আদর্শিক মানুষ হতে খুব বেশি প্রভাবিত করে। মানুষ যদি ছোটবেলা থেকে ইতিবাচক ও সু-জীবনমূখী শিক্ষা নিয়ে বড় হয় তাহলে আমাদের অধিক জনসংখ্যা ও সীমিত সম্পদের ক্ষুধা দারিদ্র্য বঙ্গদেশের সমাজ- রাষ্ট্রও একটি আদর্শিক ও ইতিবাচক ধারণার মাধ্যমে জনকল্যাণমুখী চিন্তাধারায় বিনির্মান সম্ভব।

পরিবার প্রথার প্রচলনের পরপর মানুষের জীবন ও জীবিকা তথা মৌলিক প্রয়োজনগুলি মিটানোর তাগিদে অনেক রীতিনীতি ও নিয়মকানুন প্রবর্তিত হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। একই জাতি গুষ্ঠির মনুষ্যসম্প্রদায় সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে একটি আদর্শিক ব্যবস্থাপনায় মিলেমিশে থাকার তাগিদে মানুষ গঠন করে পাড়া বা মহল্লা। এইভাবে পাড়া-মহল্লার মানুষগুলো নিরাপদ ও সুস্থদেহে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিষ্ঠা করে সমাজ ব্যবস্থা। ভিন্ন ভিন্ন বা বিভিন্ন ধারার পরিবারের কৃষ্টি কালচার ও আচার-আচরণের প্রভাবের পুরোটাই ধারণ করে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনা। সাধারণত মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সুখশান্তি ও আরাম-আয়েশকে ঝুঁকিহীন ও বাঁধাগ্রস্ত বা আপদবিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছে সামাজিক কিছু নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন। যা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সমাজের সকল মানুষের প্রয়োজন বিবেচনা করে সম-অংশগ্রহণ ও সমমর্যাদায় নির্বাচিত করা হয় এক বা একাধিক সমাজ পতি বা দলনেতা। যাদের উপর ন্যস্ত থাকে পুরো সমাজের মানুষগুলোর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অনুসঙ্গ ও মানুষের ভালো-মন্দ, ন্যায় –অন্যায় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

আমাদের এই অপরূপ শস্য-শ্যামল সোনার বাংলার মানুষের মধ্যে তিন ধরণের আচরণ ও আদর্শের মানুষ দৃশ্যমান রয়েছে। প্রথমত কিছু মানুষ রয়েছে যারা বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিজেকে বিসর্জন দিয়ে সৃজনশীল প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক প্রয়োজনগুলি সঠিকভাবে মিটানোর জন্য কঠিন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। দ্বিতীয়তঃ বেশির ভাগ মানুষ রয়েছে কোন কাজকর্ম বা পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ না করে নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে অন্যের কষ্টার্জিত উপার্জন ভোগ দখল করা। এবং তৃতীয়তঃ আমাদের মধ্যে একশ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা পরজীবি উদ্ভিদের মতো পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের উপর মুখাপেক্ষি হয়ে জীবন ধারণ করে এবং তারা শুধু মুখাপেক্ষী হয়ে সন্তুষ্ট না থেকে বরং যারা কঠিন বাস্তবতায় আত্মসংগ্রাম করে অন্যের মুখে খাবার তুলে দেয় তাদের সমালোচনা ও কুৎসা গিবাত করতে করতেই কাটায় সারাবেলা ও সারা জীবন। মূলতঃ বিভিন্ন পরিবার থেকে এই রকম তিন ধরণের মানুষের চলাফেরা আচার-আচরণ ও কাজকর্মের সম্পূর্ণ প্রভাব পুরোটাই পড়ে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে সৃষ্ট সমাজের উপর। তবুও আমরা মানুষগুলো ব্যক্তিপর্যায়ে নিজের বা পরিবারের দোষ না দেখে সমস্ত ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের জন্য সমাজকে দোষারোপ করছি নিত্য। মিটিং-সিটিং, ওয়ার্কসপ সভা-সেমিনারে টেবিল থাপড়িয়ে বলছি “গেছে গেছে এ সমাজ পুরোটাই গেছে অসামাজিক অশ্লীলতায় ও কুসংস্কারে ভরে গেছে। এ সমাজে আমি আর নাই দেশ ছেড়ে বিদেশে যাই। ভালো থাকবো ও নিরাপদ থাকবো জীবনভর”।

কাজেই আমাদের এমন একটি মানবিক ও জনবান্ধব সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে যেখানে সমাজের ধনী-দরিদ্র উঁচু-নিচু মানুষে-মানুষে কোন ভেদভেদ থাকবেনা। পরস্পর পরস্পরের কাঁধে কাঁধ রেখে ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে একে অপরের হাতে হাত রেখে সমপদে সমমর্যাদায় একটি ইতিবাচক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারি। তবেই হয়তো আমরা ভয়াবহ কোভিড-১৯সহ সামাজিক কুসংস্কার রোধে এগিয়ে আসতে পারবো এবং একটি কল্যাণকর সমাজ-পরিবার ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারবো। আর সবাই একাগ্রচিত্তে খোদার ইবাদত বন্দেগি করে মানুষের ভিতর থেকে জাতিগত বিদ্বেষ, হিংসা ও অহংকার চূর্ণবিচুর্ণ করে খোদার অপরিসীম রহমত নিয়ে সকল বাধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো। ইন শা আল্লাহ। একদিন পৃথিবীর আমরা সবাই এক হতে পারবো এবং একটি স্বাধীন ও মুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলবো।

আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বাধীন এইদেশে সুখ-স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে গিয়ে নানান সমস্যার মুখোমুখী হই আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষগুলি। মূলত ব্যক্তিজীবনকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্যই আমরা খেয়ে না খেয়ে মরিয়া হয়ে উঠি সমাজ ও রাষ্ট্রে টিকে থাকার জন্য। আমাদের এদেশের মানুষের পারিবারিক কাঠামো ও ভিত্তির উপরই নির্ভর করে সন্তানদের প্রগতিশীল ধারায় সমাজ ও রাষ্ট্রে ভূমিকা রাখা। মানুষের মতো মানুষ হয়ে ইতিবাচক ধারণা নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে বেড়ে উঠা।

আমাদের পরিবারসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ শিশুদের সুশিক্ষা ও মানুষের মতো মানুষ হতে সহযোগিতা করে আসছে। তবু কেন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে শুধুমাত্র বিত্তবান ও ক্ষমতাবান মানুষগুলি স্বস্ব মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়? সমাজ ও রাষ্ট্র কেন প্রতিভাবান তরুণতরুণী ও কিশোরকিশোরীদের সৃজনশীলতায় মূল্যায়ন করেনা? সমাজের কাছে তো সকলেই সমান দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনধারণের অধিকার রয়েছে?

একজন সচেতন ও নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে এই প্রশ্নগুলি সমাজ ও রাষ্ট্রকে করা আসলে বোকামির পরিচয় দেয়া যা সম্পূর্ণ অনুচিত। কারণ আমরা শুধুমাত্র জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে ধারস্থ হই। আমাদের অধিকারগুলির সমমর্যাদা ও সমসুযোগে পেতে হলে আগে চাই আমাদের প্রয়োজনীয় মেীলিক চাহিদা নিরসনবান্ধব একটি নিরাপদ মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিনির্মান করা। তা করতে হলে আমাদের নিজেদেরকে সময়োপযোগী ও যুগোপযোগী করে তৈরি হয়ে নিতে হবে। এবং আমাদের পরিকবারের মানুষগুলিকে কুসংস্কারচ্ছন্ন ভাবনাচিন্তা ও ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ভেবে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রগতিশীল ধারায় নির্মাণ করা সম্ভব হতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলছে যার প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এই সমাজ ও রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর নয় যা যথেষ্ট অমানবিক। এদেশের প্রতিটি পরিবার ও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশু-কিশোরদের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য নৈতিক আদর্শবান যুগোপযোগী শিক্ষা দান করে। তবুও কেন সমাজের কর্মক্ষেত্রে এতো অন্যায়-দূর্নীতি এবং কিশোর-কিশোরী-যুবক-যুবতীসহ আপাময় জনসাধারণের এতোটা নৈতিক অবক্ষয়? এই প্রশ্নটা দেশের বরণ্য দেশগড়ার কারিগর, নীতি নির্ধারক তথা সুশীল সমাজ তথা সচেতন মহলের কাছে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ।

সমসাময়িক বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি পড়ালেখা শেষ করে বা পেশাগত কোন বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের বা পরিবারের জীবন ও জীবিকার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের সরকারি-অসরকারি ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীর কাছে কর্ম সংস্থানের জন্য ধারস্থ হয়। অথবা কিছুকিছু ব্যক্তি নিজস্ব সৃজনশীলতা ও যোগ্যতা এবং দক্ষতা খাটিয়ে ব্যবসা করার জন্য মনোস্থীর করে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই যারা বিত্তবান বা ক্ষমতাবানদের পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাদেরই আগে কর্মসংস্থান বা ব্যবসা শুরু করতে পারে। আর যারা গরীব বা সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠির পরিবার থেকে এসেছে তারা বহু সাধনার পরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগের জন্য ব্যবসাও শুরু করতে পারেনা। তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্র শুধুই দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করে। আবার কিছু কিছু ব্যক্তি বা মানুষ রয়েছে যারা সমাজের নির্মম বঞ্চনা ও অবহেলা এবং দান দক্ষিণা পছন্দ করেনা এবং প্রতিবাদ করে। তাদের কপালে আরও বেশি দূর্ভোগ রয়েছে। গাঁও গেরামে যদি বসবাস করে তাহলে বিভিন্ন অপবাদ বা সামাজিক কুসংস্কারচ্ছন্ন বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে তাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে মফস্বল বা শহরে যদি তার বসবাস হয় তাহলে জোর-জুলুম-অত্যাচার-মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন বা নির্বাসিত করে রাখে অথবা তাদেরকে একেবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

আমাদের দেশের পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষগুলো সুষ্ঠু শান্তি মতে জীবন জীবিকা পরিচালনা করার জন্য সাধারণত তিন ধরণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। প্রথমতঃ পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র যেভাবে এবং যেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঠিক সেইভাবে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে একই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। দ্বিতীয়তঃ কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যারা সাধারণত বহু সংগ্রাম করে অনেক বঞ্চনাগঞ্জনা সহ্য করেও নিজের সততা ও দক্ষতা দিয়ে যা পায় তাই জীবন জীবিকার পাথেয় হিসেবে বরণ করে নেয়। তৃতীয়তঃ যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের অকল্যাণকর ও অতি অমানবিক কার্যক্রম মেনে না নিয়ে প্রতিবাদ করে থাকে তারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকেতো কিছুই পায়না আবার প্রতিবাদ করে সমাজের মূলস্রোত থেকে ছিঁটকে পড়ে হয়তো বিদেশে চলে যায় বা দেশে থাকলেও সুপ্ত অবস্থায় নির্বাসিত থাকে।

বস্তুতঃ আমাদের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণকর ও সুষ্ঠু-সুন্দর ভাবে তৈরি করতে হলে হিংসা-বিদ্বেস-অহংকার ও সামাজিক কুসংস্কার ভুলে যেতে হবে। আমরা আমাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তণ করার জন্য আমাদের মানবিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভূমিকা রাখা দরকার। সমাজ থেকে সাধারণ ও দরিদ্রদের উপর শোষণ-নিপীড়ন ও জীববৈচিত্র ধ্বংস এবং গুম-খুন ও অন্যায়-অত্যাচার বন্ধ করে বৈষম্যহীন নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সমাজ থেকে চিরতরে মুনাফাভোগী আচরণ, ভোক্তা-সাধারণদের থেকে ভেজাল-দূর্নীতি বন্ধ করে আমাদেরকে সম্পদ ভোগ বন্টনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা ও মুক্তবাজার অর্থনীতি সুষ্টি করতে হবে। আমাদের বাংলাদেশের এই সমাজ ব্যবস্থা থেকে অবশ্যই সমাজপতিদের শোষণ-শাসন ও রক্তচক্ষু এবং ধনী-দরিদ্র উঁচু-নিচু ব্যবধান চিরতরে দূর করতে হবে যাতে করে এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেএকটি সুখীসমৃদ্ধ ও মানবিক এবং কল্যাণকর করে বিনির্মাণ করা আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি সুনাগরিকের প্রধান দায়িত্ব।

একটি সুখী সুন্দর সবুজ সোনার বাংলাদেশ তৈরিতে অবদান রাখতে গেলে অবশ্যই আমাদের অধিক জনসংখ্যাকে আশির্বাদ হিসেবে দেখতে হবে এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তর করতে হবে। তারজন্য আমাদের প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হলো আটষট্রি হাজার গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপযোগী ধারণায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তৈরি করতে হবে। পরিবারের কার্যক্রম-ই সমাজ ও রাষ্ট্রেকে বেশির ভাগ প্রভাবিত করে। কারণ মানুষ কোন না কোন পরিবার থেকে উঠে এসেই জীবন ও জীবিকা পরিচালনার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রে একজন নাগরিক হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়। পারিবারিক শিক্ষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সে লালন-ধারণ ও বহন করেই সে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভূমিকা করে। আমাদের সন্তানদের আচার-আচরণ ও নৈতিক ব্যবহার পারিবারিক শিক্ষার উপরই বেশির ভাগ নির্ভরশীল। আমরা মা-বাবাকে যেমন করে ভালোবাসি তেমনি যদি আমাদের দেশ-ভাষা-জাতীয়তা ও কৃষ্টি-কালচারকে ভালোবাসি তবেই আমরা নিজেকে একজন এদেশের স্বাধীন ও মুক্তমনের প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে দাবী করতে পারবো। আমাদেরকে অবশ্যই কুসংস্কার বিবর্জিত ইতিবাচক ধারণায় সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যার জন্য আগে চাই প্রতিটি পরিবারকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রগতিশীল ইতিবাচক ধারণায় যুগোপযোগী করে বিনির্মাণ করা। একটি সুন্দর সবুজ অপরূপ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিটি পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts