আসাদুজ্জামান
স্বাধীন বাংলাদেশ শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার। শেখ হাসিনা এক মহাজাগরণের নাম। শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশের প্রতিটি মাটিকণাও তাঁকে ভালবাসে অকুন্ঠচিত্তে।
রাজনৈতিক মুক্তিকে অর্থনৈতিক মুক্তিতে পরিণত করার অনবদ্য চেষ্টায় যখন নিবেদিত ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিক তখনই শিকার হতে হয় পরিবার-পরিজনসহ এক বর্বোরোচিত হত্যাকাণ্ডের। ফলে, দীর্ঘ সামরিক শাসনের নিগড়ে বন্দি হয় এ বাংলার মানুষ।
পিতার আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য ১৯৮১ সালের ১৭ই মে প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তাঁরই অকুতোভয় কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জাতির পিতার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও বাঙ্গালির হারানো অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠ করার লক্ষ্যেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগমন করেন। কারণ, রাজনীতি তাঁর উত্তরাধিকার। তিনি যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। রাজনীতি তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন। রাজনীতিই হলো তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর রক্তের প্রতিটি অণুতে গভীরভাবে গ্রথিত আছে পিতার আর্দশিক রাজনীতির চেতনা আর অধিকার হারা মানুষের ক্রন্দনের স্পন্দন।
সেদিন একাত্তরের ঘাতক গোষ্ঠি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর আগমনকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে, একাধিকবার তাঁকে অন্তরীণ হতে হয়েছে। বারংবার আঘাত এবং হামলা এসেছে তাঁর জীবনে। শেখ হাসিনাকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এ যাবত ঊনিশবার হত্যার উদ্দ্যেশে হামলা করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট শেখ হাসিনার উপর হামলা তারই ধারাবাহিকতা। তবে, ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দ্যেশে তাঁর সমাবেশে যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল তা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, প্রলয়ঙ্ককারী, পৈশাচিক ও রক্তক্ষয়ী। কিন্তু ঘাতকদের সকল অপচেষ্টা ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বেঁচে যান বাংলাদেশের মানুষের আশা ও ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল প্রাণপ্রিয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীন বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগস্ট যেন বাঙালি জাতির জীবনে বিয়োগাত্মক মাস। হত্যা, অপমৃত্যু আর স্বজন হারানোর মাস। জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার মাস। একাত্তরের পরাজিত শত্রু ও তাদের দোসররা বারবার বেছে নিয়েছে অভিশপ্ত আগস্টকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তঝরা ঘোর অমানিশার রজনীতেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী পাষণ্ড সদস্যের নির্মম বুলেটের আঘাতে শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
সেই সময় প্রবাসে থাকায় ভয়ঙ্কর এ হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারই ধারাবাহিকতায় এ আগস্ট মাসেই যুদ্ধের মারণাস্ত্র ভয়াল গ্রেনেড হামলা চালিয়ে প্রাণ ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতেই সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র।
শোকাবহ রক্তাক্ত আগস্ট মাসেই ১৫ আগস্টের মত আরেকটি পৈশাচিক ও নৃশংস ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশ্যেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সমাবেশস্থলে ঘাতক হায়েনার দল গ্রেনেড হামলা করে রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে আবারও ঘাতকদল এই আগস্টেই জোট বেঁধেছিল। এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশ্যই ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বশূন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিনটি ছিল শনিবার। সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালিন বিরোধীদলীয় নেত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে সভামঞ্চ নির্মাণ করা হয়। অতঃপর বিকাল ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর বক্তব্য দিতে শুরু করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ লগ্নেই তাঁর হাতে থাকা মাইক স্পিকারটি টেবিলে রাখতে না রাখতেই শুরু হলো নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝেই ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ মানববর্ম তৈরী করে প্রিয়নেত্রী ও বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে তাঁরা প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এক থেকে দেড় মিনিটের ব্যবধানে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা বরং গ্রেনেডের আঘাতে পরাস্ত করতে না পেরে ওইদিন শেখ হাসিনার গাড়িতে ছুড়েছিল বৃষ্টির মতো গুলি। একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের ছোড়া গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়িটির কাচ। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুব।
অতঃপর জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ সর্বোপরি পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে মৃত্যুজাল ছিন্ন করে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিকল্পিত হামলায় ২১শে আগস্টের সেই রক্তাক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। নারী নেত্রী আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন, যাদের দুই জন অজ্ঞাতনামা ও ২২ জনের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হলেন-আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও নারী নেত্রী আইভি রহমান, শেখ হাসিনার দেহরী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুব, মোশতাক আহমেদ সেন্টু, হাসিনা মমতাজ রিনা, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসির উদ্দিন সরদার, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, জাহেদ আলী মোতালেব ও সুফিয়া বেগম।
আহত হয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (আওয়ামী লীগের তৎকালিন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য) জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এসএম কামাল হোসেন, পংকজ দেবনাথ, সাঈদ খোকন, নজরুল ইসলাম বাবু, হারুনুর রশীদ হাওলাদার, নাসিমা ফেরদৌসী, শাহিদা তারেক দিপ্তী, উম্মে রাজিয়া কাজল, আসমা জেরিন ঝুমু, রাশেদা আক্তার রুমা, আবুল হোসেন মোল্লা, মামুন মল্লিক, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, হামিদা খানম মনিসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা নিয়েও প্রহসন করে তৎকালীন সরকার। এ নারকীয় হামলায় গ্রেনেডের স্প্লিন্টার অনেক নেতাকর্মীর শরীরে রয়ে যায় এবং শরীরে এসবের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাবের কারণে দূর্বিসহ যন্ত্রনার কাছে হার মেনে অনেকে শাহাদত বরণ করেছেন।
অতঃপর শুরু হয় জজ মিয়া উপাখ্যান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হোতাদের শুরু থেকেই আড়াল করতে তদন্তের গতিপথ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মত ভয়ঙ্কর এ ঘটনায় মামলা করলে পুলিশ তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে এ হামলার বিষয়ে দুটি মামলা করা হয়। দীর্ঘদিন এ মামলার কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এ মামলা অগ্রগতি লাভ করে। এ মামলায় দণ্ডিত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং তাদের দণ্ড অতিসত্বর কার্যকরের জোর দাবি জানায় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ।
পনেরো আগস্টের মতই একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক কালো অধ্যায় এবং দুইটি ঘটনাই একইসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই ঘাতক গোষ্টি তাঁর অকুতোভয় কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। কারণ, তারা জানে বঙ্গবন্ধুর পরে একমাত্র শেখ হাসিনাই বাঙ্গালি জাতির স্বার্থে আপোষহীন নেতৃত্ব এবং তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি জাতি বাস্তবে অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। তাই, বাঙালি জাতিকে আবারো অস্তিত্বহীন এবং বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতেই ঘাতকদল ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট নারকীয় পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।
শেখ হাসিনা আজ বিশ্বের বিস্ময়। পরাজিত অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে শেখ হাসিনা আজ বিজয়ীবেশে বীরদর্পে জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ধ্যানে নিমগ্ন। বাংলাদেশের মানুষের সীমাহীন ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাসই তাঁর শক্তি ও প্রেরণার মূল উৎস। জননেত্রী শেখ হাসিনা আপন কর্ম ও মহিমায় হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের নির্মাতা, হিমাদ্রি শিখর সফলতার মূর্ত-প্রতীক ও উন্নয়নের কান্ডারি। তিনি স্বীয় পিতার মতই অন্ধকারের বিরুদ্ধে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, সংকটে অপ্রতিরোধ্যভাবে অকুতোভয় নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়ার এক বিরল রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত। সর্বোপরি একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির সকল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও সংকট প্রতিহত করতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী বাঙ্গালি নেতৃত্ব সর্বদাই জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে থাকবে প্রতিবাদী স্পর্ধায়।
আসাদুজ্জামান: গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: asad.zoolru@yahoo.com