এম. এ. কাদের
আজ ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রবীণের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এক সময় পরিচর্যাহীন বার্ধক্যই দেশের একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
বেসরকারি এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবনযাপন করছেন। সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবেলা করার মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের নেই। এ কারণে এখন থেকেই প্রবীণদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছেন; বাইরে থেকে তা উপলব্ধি করা যায় না। অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে আলাদা রাখা, বাড়ি পাহারা, বাজার করানো, সন্তানকে দেখাশোনা ও স্কুলে পাঠানো, ধমক দিয়ে কথা বলা, অপমানজনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-বাড়িটুকু জোর করে লিখে নেওয়া হচ্ছে। অনেকেই সন্তান ও পুত্রবধূর কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার। এমনকি মাদকাসক্ত ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়িতে রেখে তালা বন্ধ করে নিয়মিত স্বামী-স্ত্রী কর্মস্থলে চলে যাচ্ছে। তাদের রুমে আটকা রেখে ৫-৭ দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে। তা ছাড়া পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবারের সব সদস্য অংশগ্রহণ করলেও পিতা-মাতাকে ঝামেলা মনে করে সঙ্গে নেওয়া হয় না। প্রবীণদের থাকার জায়গাও নিম্নমানের। যেমন বাড়ির নিচতলা, বারান্দা, চিলেকোঠা, খুপরিঘর, গোয়ালঘর এমনকি বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে অমানবিকভাবে থাকতে দেওয়া হয়। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে অসুস্থ পিতা-মাতার খোঁজখবর পর্যন্ত নিতে চায় না। আবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে অনেক সন্তান বাবা-মার যতœ নিতে পারেন না। অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের এই কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। এত কষ্টের পরেও কেউ ভালো-মন্দ জানতে চাইলে সন্তানের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য বলেন, ‘খুব ভালো আছি।’
যে প্রবীণ যৌবনে তার মেধা-মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানবকল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটি অযত্ন-অবহেলায় আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হন। আপাতদৃষ্টিতে সমাজ বা সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, অনুরূপ প্রবীণদের জন্যও শুধু সন্তান নয়; সমাজ ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রবীণদের এই অসহায়ত্ব-দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে।
অনেক সন্তান তাদের ব্যস্ততার কারণে বাবা-মা থেকে দূরে থাকায় তাদের পরিচর্যা বা সেবা-যত্ন করতে পারে না। অনেক পিতা-মাতা ভিটামাটি ছেড়ে সন্তানের সঙ্গে বিদেশে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। নানা কারণে দিন দিন বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি ও সুসম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। এর সঙ্গে আরেক সমস্যা দেখা দেয় তা হলো, পুত্রসন্তান না থাকা। অনেকেই জামাইবাড়িতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায়; কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সঙ্গে বসবাসের জন্য ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তোলা। যেখানে স্বেচ্ছায় প্রবীণরা থাকতে চাইবেন। প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তুলতে নিজ দায়িত্বে এগিয়ে এলে সত্বর তা বাস্তবায়ন সম্ভব। ইতিমধ্যে এ মহৎ উদ্যোগকে বেশিরভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছেন। এখন সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেইল: makader958@gmail.com