আতাউর রহমান মারুফ
আবুল হোসেন (ছদ্মনাম) সৌদি আরব থেকে ২০২০ সালের শুরুতে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। অত্যন্ত নিরীহ এক নিয়ত ছিল তার মনে। বিয়ে করবেন। নতুন সংসার গুছিয়ে বিদেশ ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতির মধ্যেই শুনলেন করোনা ভাইরাসের কথা।
পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই দেখেন সব দেশ তাদের বিমানবন্দর বন্ধ করে দিচ্ছে। তার মালিক বা কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে অপেক্ষা করতে বলে। সেই অপেক্ষার অবসান আর হয়নি। এক পর্যায়ে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কফিল বলেছিল আকামার মেয়াদ বাড়াবে। তাই তিনি তিনি কাগজপত্র পাঠান সৌদি আরব। এরপর থেকে কফিল তার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এখন নতুন করে বিদেশ যেতে কয়েক লাখ টাকা প্রয়োজন। আগেরবার বিদেশ যাওয়ার ঋণ এখনো শোধ করতে পারেননি। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে কোনো ধরণের সঞ্চয়ও করতে পারেননি। নতুন সংসারে যোগ হয়েছে বাড়তি কিছু খরচ। এত সব ব্যায়ের পাল্লার বিপরীতে তার আয়ের পাল্লা শূন্য। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
অনিশ্চয়তা থেকেই মানুষের মনে যাবতীয় সব দুশ্চিন্তা ভর করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বৈশ্বিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক মন্দার সময় বেকারত্ব বাড়ে, আয় কমে যায় এবং ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। এর ফলে মানসিক স্বাস্থ্য দূর্বল হয়ে যায়, মনের অসুখ সংক্রান্ত সমস্যা বেড়ে যায় এবং পরিণতিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। আবুল হোসেন এই বৈশ্বিকমন্দার শিকার হয়েছেন, যেটার উৎপত্তি হয়েছে করোনা মহামারির প্রকোপ থেকে। সম্প্রতি ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক জরিপে দেখা যায়, ৯৮ শতাংশ বিদেশ-ফেরত অভিবাসী অপর্যাপ্ত আয়, বেকারত্ব এবং পারিবারিক চাপ ইত্যাদি কারণে চরম উদ্বিগ্নতা ও মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। আবুল হোসেন এসব অভিবাসীদেরই একজন। চরম নাজুক মানসিক পরিস্থিতিতে দিনযাপন করছিলেন। করোনার অভিঘাতে তার জীবন হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ।
প্রতিদিনের যাপিত জীবনে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করি, চাপ অনুভব করি। সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সেটা প্রতি মূহুর্তের ব্যাপার হয়ে ওঠে, তবে ব্যক্তিজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠতে পারে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করলে সেটা দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়। কোনো কিছু নিয়ে প্রতিমূহুর্ত চাপে থাকলে সেটা মানষিক উৎকন্ঠায় পরিণত হয়। মনের ওপর এই অযাচিত চাপ ব্যক্তিকে শারীরিকভাবেও দুর্বল করে দেয়। অনিদ্রা হয়। অরুচি হয়। মনের স্বাভাবিক চিন্তা ব্যাহত হয়। জীবন নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আবুল হোসেন প্রায়ই সবগুলো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বহুমুখী চাপের ফলে তিনি জীবন নিয়ে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
বাংলাদেশে সাধারণত মনের অসুখের জন্য চিকিৎসার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। মনের মধ্যে গুমরে থাকা কষ্টের পাহাড়গুলো সহজে কারো সঙ্গে ভাগাভাগিও করা যায় না। অথচ এটা হচ্ছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের জন্য সেটা আরো কঠিন। কারণ দীর্ঘদিন বিদেশ থাকার ফলে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে তাদের এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। তাই ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের মনো-সামাজিক কাউন্সেলরদের একটি বড় টিম এই শূন্যতা পূরণ নিয়ে কাজ করছে। তারই অংশ হিসেবে আবুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
প্রাথমিক সব তথ্য নেয়ার পর আবুল হোসেনের সঙ্গে একান্তে কাউন্সেলিং সেশনের জন্য বসা হয়। তার দু:খ-কষ্ট, হতাশা, আশা -নিরাশার কথা বলতে পেরে তিনি কিছুটা হালকা বোধ করেন। মানসিক উৎকন্ঠায় থাকা রোগীরা কেউ মৃদু বা কেউ খুব তীব্র সমস্যায় ভোগেন। আবুল হোসেন প্রথম পর্যায়ের ক্লায়েন্ট। ফলে অল্পতেই তিনি চাঙ্গা হয়ে ওঠতে শুরু করেন। এর পাশাপাশি জীবনের অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে শুরু করেন। প্রথমদিকে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। বিদেশ যাবেন পুনরায় নাকি দেশে কোনো কিছু করবেন। কিন্তু কাউন্সেলরের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তিনি প্রথমে তার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন। সেসব সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানগুলো যাচাই-বাচাই করেন। যেমন বিদেশ যেতে তাকে পুনরায় ঋণ করতে হবে। কিন্তু পূর্বের ঋণ পরিশোধ না হওয়া ও করোনার কারণে আত্মীয়-স্বজনদের আয় কমে যাওয়ায় ঋণের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আবুল হোসেনের পুনরায় বিদেশ যাওয়ার সম্ভাবনা আপাতত স্থগিত রাখেন। এরকম ধরে ধরে বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানগুলো যাচাই করেন। এভাবে একটা পর্যায়ে তিনি নিজের অবস্থা বুঝতে পারেন এবং একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। নিজের যে দক্ষতা আছে সেটা ব্যবহার করে দেশেই স্বাবলম্বী হতে পারবেন বলে আশা করেন। ক্রমান্বয়ে আবুল হোসেন জীবনের ব্যাপারে ইতিবাচক ও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করা মানুষেরা অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে নিয়মিত সংগ্রাম করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকে। কিন্তু যারা দরিদ্র ছিল না, অথচ দীর্ঘদিন ধরে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে আছে তাদের জন্য নতুন বিরুপ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা কঠিন। বিদেশ ফেরত এসব অভিবাসীরা একটা নির্দিষ্ট আয়মূলক কাজে জড়িত থাকলেও এখন কোনো আয় না থাকায় তারা ভীষণ চাপ ও বিষন্নতায় ভুগতেছেন। তাই সমানুভূতি সহকারে তাদের কষ্টের কথা শোনা প্রয়োজন, তাদের ভেঙ্গে পড়া মনে আশার আলো জ্বালানো ভীষণ জরুরি। তাহলে বৈষম্যের এই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে।
আতাউর রহমান মারুফ: সেক্টর স্পেশালিস্ট-কাউন্সেলিং, ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম।