সোনার বাংলার জাগরণে কৃষির ভূমিকা অন্যতম

ম্যাকি ওয়াদুদ

 

খুব ছোটবেলা বলতে আশির দশক থেকে জেনেছি বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর বা কৃষি প্রধান একটি দেশ। এদেশের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। জীবন ও জীবিকার প্রধান ও অন্যতম উপায় কৃষিকাজ করা বা গৃহস্থালী কাজের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদা মিটায়ে স্বনির্ভর হওয়া। গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ। মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়ে তেমন একটা চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হতোনা সংসারধর্ম নিয়ে।

তখন ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে এতোটা বৈষম্য ছিলোনা। ধনী-দরিদ্র সবাই মিলেমিশে একাট্টা হয়ে সমাজে একই পরিবারের মতো বসবাস করতো। একে অপরের সুখদুঃখে আনন্দ-উল্লাসে এগিয়ে আসতো। বিনিসুতার এক নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে থাকতো পুরো গ্রামবাসী। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান একত্রে জাতিধর্ম-বর্ণ হিংসা-বিদ্বেষ-অহংকার ভুলে কাঁধে কাঁধ রেখে একই মন্ত্রে দিক্ষিত হতো। সবার বাড়িতে বাড়িতে গরু-ছাগল-হ্যঁস-মুরগী এবং বসতঘরের পাশে খড়ের পারা ও গরুর ঘর দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে বদলে গেছে মানুষের চারপাশ, ঘরবাড়ি এবং বদলে গেছে গ্রামীণ জনপদের জীবন ও জীবিকার চিরচেনা চিত্রপট।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণজয়ন্তী শেষান্তে অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর পর আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা বাংলার মানুষের জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়নের জন্য আমরা অনেক কিছু পেয়েছে। বস্তুত ঘনবসতি অঞ্চল তথা অধিক জনসংখ্যার দেশে আমরা খাদ্যে যেমন করে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করেছি তেমনি আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়ে গেছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে অনেক অনেক বেশি স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদা ও সম্মানিত জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। কৃষি সেক্টরে আমরা অনেক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি জীবন ও জীবিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ আধুনিক বিশ্বের সাথে সমস্বয় করে জীবন ধারণের প্রণালীকে আমরা সহজ করতে পেরেছি। বাংলাদেশ খালবিল নদীনালা ও সাগর অর্থাৎ জলজ সম্পদ পর্যাপ্ত থাকাতে তা কৃষি ও কৃষিজ অনুসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অবদান বহন করছে।

তবে আমরা যে পেয়েছি শুধু তাই নয়! আমরা হারিয়েছিও অনেককিছু। বিশেষ করে কৃষিজ ঘরানায় বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত প্রাচীন যন্ত্রাংশ যেমন- লাঙ্গল-জোয়াল, মই, কাঁচি, কোদাল, নিড়ানি ইত্যাদি হারিয়েছি। এখন অগ্রাহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসব হয়না, শীতের রাতে উঠানে কৃষাণ-কৃষাণী জেগে বাড়ির উঠানের মধ্যখানে কেটে আনা ধান রেখে গরুদিয়ে ধান মাড়াই দিইনা। কৃষাণী বউঝিরাও আর বোধ হয় ধানে নিড়ানির সাথে সাথে পল্লীগান ফোক গানের আনন্দউৎসবে ফেটে পড়েনা। আমরা এখন বর্ষাকালে খালেবিলে ও মাঠপ্রান্তরে ব্যাঙের গ্যাঙর-গ্যাঙ অতোটা শুনতে পাইনা। ব্যাঙ হলো পরিবেশের বন্ধু। কৃষিজ ফসলের ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে ব্যাঙ রক্ষা করতো। ফসলের ভালো ফলনের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক সার, কীটনাশক এর প্রয়োজন হতোনা তেমন একটা সোনার এই বাংলাদেশের কৃষিভূমিতে। একধরণের দুষ্টচক্র বাংলাদেশের সেই বড় বড় কোলাব্যাঙ, কুনোব্যাঙগুলি বিদেশে পাচার করে দিয়ে এদেশের গ্রামীণ মাঠপ্রান্তরকে অনেকটা ব্যাঙশূন্য করে দিয়েছে। আগে বিশেষ করে সন্ধ্যার পর মেঠোপথের রাস্তায় পায়ের নীচে পড়তো ব্যাঙ আর ব্যাঙ। এখন কীটনাশক সার ব্যবহার না করলে জমিতে ফসলও হয়না। খাদ্যে আমরা স্বাদগন্ধ দুটোই হারিয়েছি। পাশাপাশি দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যসামগ্রীতেও পিজারভেশন এর নাম করে কার্ভাইড, ফরমালিন এতাটাই ব্যবহার করে যাতে খাদ্য শষ্যের মৌলিকত্ব ও প্রকৃত গুণাগুণ হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশে প্রাচীন চাষাবাদে কীটনাশক ওষুধ, সার ইত্যাদি তেমন একটা ব্যবহার করা হতোনা। নদীমাতৃক বাংলাদেশে কৃষিজমি পলি ও দোঁয়াশ মাটির সমন্বয়ে খুবই উর্ভর। কৃষি জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ ও আগাছা পরিষ্কার করে জৈব সার প্রয়োগ করেই জমিতে ফসল ফলাতো নিশ্চিন্তে। চাষিদের মুখে-মুখে ছিলো ক্ষনার বচন। তারা স্কুল-কলেজে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও বাংলাদেশের ষড়ঋতুর তারতম্যের রোদ-বৃষ্টি ও আবহাওয়া অনুযায়ী ফসল ফলাতো। আর প্রতিটি চাষির মুখস্থ ছিলো ক্ষনার বচন। যুগযুগ ধরে ক্ষনার বচন গুলি গ্রাম-বাংলার জনজীবনের সাথে মিশে বাংলাদেশকে কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে এবং সীমিত জমিতে অধিক ফসল ফলিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করেছিলো। তাই এখনও একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশেষ করে আধুনিক টেকসই কৃষি সেক্টরে ক্ষণার বচনগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এখনো ক্ষনা বেঁচে আছেন সারা পৃথিবীতে তাঁর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ১৫০টিরও অধিক বচনের জন্য। তম্মধ্যে একুশটি সার্বজনীনভাবে সত্য প্রমাণিত। ‌

-ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা,
তার অর্ধেক ধান,
তার অর্ধেক পান,
খনার বচন, মিথ্যা হয় না কদাচন।

– ক্ষেত আর পুত,
অযত্নে যমদূত

– মাটি শুকালে দিও জল,
সকল মাসেই পাবে ফল। -ইত্যাদি।

আশির দশকের সময় বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ছিলো জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। এই অধিক জনসংখ্যার চাহিদানুযায়ী মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য সমস্যা দূর করার জন্য এদেশের কৃষিজমিতে উচ্চফলনশীল বা হাইব্রিড ফসলের বীজ বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়েছিলো। আবার এদেশের উর্বর মৃত্তিকায়ও হাইব্রিড ফসল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ঔষধ ও সার ব্যবহার করতে হতো বাধ্যতামূলক। এতে করে আমরা খুব ধীরে ধীরে হাইব্রিড বীজের জন্য বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়েছি। তাছাড়া আমাদের দেশিয় জাতের বীজগুলো অযত্নে অবহেলায় মানুষের কাছ থেকে অনেকটা বিলীন হওয়ার পথে। এখন কাঁচাবাজারে গেলেও কোন প্রকারে দেশি জাতের সবজি খুব একটা দেখা যায়না। খাবারের মধ্যে আগের সেই দেশি স্বাদ অনেকটা এখন আর আমাদের জিহ্বায় বুঝা যায়না। শুধু বেঁচে থাকতে হলে খেতে হয় তাই আমরা খাচ্ছি। তবে চোখ বুজে গিলতে হচ্ছে গোগ্রাসে।

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। বাংলাদেশের বড় বড় নদী ও সাগরের মোহনায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে অবাক বিষয়টি হলো যে সমস্ত জেলে মাছ ধরে বা এদেশের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষগুলির কাছে ইলিশ মাছ ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এক কেজি মাছ যদি হাজার টাকা হয় তাহলে উচ্চবিত্তরা ব্যতিত এমাছ কেউ খেতে পারার কথা নয়। তাছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা এই মাছ বিদেশে পাচার করেও কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি করে তুলে। আমাদের জাতীয় ফুল হলো শাপলা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের যেখানে সেখানে শাপলা ফুটে। তাছাড়া শাপলা সবজি হিসেবেও মজার খাবার। কিন্তু কিছু-কিছু গ্রামের বাজার ছাড়া এই শাপলার দেখাই মিলেনা।

বিশ্বের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ যেখানে এদেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় বিশেষ করে খাদ্যে ভেজাল মিশায় এবং দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। ফল, মাছ, মাংশ, শাক সবজি সকল কিছুতেই অতিমাত্রায় ফরমালিন বা কৃত্রিম ক্যামিক্যাল ব্যবহার করে ওজন বৃদ্ধি করে এবং পচনশীলতা এড়িয়ে সতেজ ও তাজা বানিয়ে মানুষের কাছে উপস্থাপন করে। আমরা যা খেয়ে খুব ধীরে ধীরে বিভিন্ন রোগশোকে আচ্ছন্ন হয়ে জিন্দা মরা হয়ে পড়ছি। আমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশের মানুষ ও দেশিয় সম্পদের প্রতি কোন আগ্রহ ও মায়া-মমতা কাজ করেনা। আমরা রীতিমত দেশিয় কৃষ্টি-কালচার-ঐতিহ্যকে অবহেলা করে বিদেশি সংস্কুতি ও বিদেশের চটকদারীতে আচ্ছন্ন হয়ে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি নিজের অগোচরে। বাজারে গেলে চায়নিজ গাজর, ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ রসুন, পাকিস্থানি আপেল-আঙ্গুর এগুলোর প্রতিই আমাদের নজর যায় বেশি। কারণ দেশিয় পণ্যের থেকে বিদেশী পণ্য অনেক সস্তা। তাছাড়া বিদেশি জিনিস মানেই ভালোমানের এই রকম একটি স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য বাঙ্গালী জাতির রয়েছে। বাড়ির গরু ঘাটার ঘাস খায়না। আমাদের এই অভ্যাসগুলির জন্য আমরা নিজেকেই নিজে হত্যা করছি।

একবিংশ শতাব্দির বৈশ্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি নিঃসন্দেহে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তথা ডিজিটাল বিপ্লবের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমাদের আধুনিক বিশ্বের সমস্ত চালিকা শক্তির নিয়ামক সহজ ও দ্রুততর কার্যকরভাবে প্রতিদিন নবনব সম্ভারে এগিয়ে যাচ্ছে । বৈশ্বিক তথা বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরেও প্রযুক্তির অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে সীমিত সম্পদ বা কৃষিজ ভূমি ও অতিরিক্ত জনসংখ্যা সত্বেও কৃষি সেক্টরে আধুনিক টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এই বিশাল জনসংখ্যার চাহিদানুযায়ী যোগান দিতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছেনা। আমাদের মনুষ্য-জগতের প্রধান চারটি মৌলিক চাহিদা যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসার অধিকাংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই অবশ্যই আমাদের কৃষিসহ কৃষিজ অনুসঙ্গের সাথে জড়িত উপাদানসমুহের মধ্যে ডিজিটাল বিপ্লব তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ব্যবহার একান্তভাবে উপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

বর্তমান বৈশ্বিক করোনার প্রভাবে বিশ্বের সাথেসাথে বাংলাদেশের আর্থ-সামজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছে। শুধু করোনা নয় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পানের আঘাতেও উপকূলীয় জেলাসমুহের কৃষিখাত ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ ও দুর্যোগের ফলে উন্নয়নশীল এদেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে অনেকটা স্খবির হয়ে গেছে। শুধু কৃষিকাজ নয় এদেশের পরিবহন, মার্কেটিং ও সাপ্লাই চেইন এবং পরিবহন ব্যবস্থাও থমকে গেছে অনেকাংশে। এদেশের বেশীর ভাগ মানুষ শ্রমজীবি যারা দিনে এনে দিনে খায়। এসময়ে অদুশ্য সর্বগ্রাসী এই ভাইরাসের কারণে মানুষ ঘরবন্দি থাকার ফলে উৎপাদনে এবং ফসল বা খাদ্য শষ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্যক্রম প্রবলভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের দেশে মানুষের জীবন-যাপন বা আয়রোজগারের সঙ্গে তিনটি অনুসঙ্গ সবচেয়ে বেশি করে জড়িত। তা হচ্ছে বৈদেশিক রেমিটেন্স, গার্মেন্টস-শিল্প এবং কৃষিখাত। তবে কৃষির উপরই আমাদের নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশী। সাম্প্রতিক করোনা সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপর নেমে পড়েছে কঠিন বাস্তবতা, কর্মহীন এবং বেকার। প্রতিদিন সময়মতো কাজ পাওয়ার কারণে নিজের ও পরিবারের অন্ন,বস্ত্র ও চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে-ধুঁকে মরছে। ফলশ্রুতিতে খাবারের অভাব ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বিঘ্নতার ফলে এদেশের মানুষ এখন বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।

বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিত। নদীমাতৃক বঙ্গোপসাগরের বদ্বীপের পলিমাটির উর্বরতায় প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমানে ধান, পাট, গম, ভুট্টা,ডালসহ নানারকম শকিসবজি জম্মে। তাছাড়া অধিক জনসংখ্যার এদেশে রয়েছে প্রচুর কর্মঠ শ্রেণির শিক্ষিত যুবক যুবতী। তারা বেশির ভাগ আধুনিক লাগসই প্রযক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিথাতকে চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছে দিয়ে সীমিত জমিতে অধিক ফসল ফলিয়ে দেশ-বিদেশের মানুষের অন্ন-সংস্থান করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। একসময় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একমাত্র প্রধান সমস্যা ছিল অধিক জনসংখ্যা অর্থাৎ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। এদেশের মেধাবী তরুণসমাজ কঠিন পরিশ্রম উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ করে তৈরি করে দেশের অভিশাপ থেকে আর্শিবাদে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া কৃষিপ্রধান এদেশে রয়েছে কৃষি ও কৃষি অনুষঙ্গের সাথে জড়িত সকল খাতের রিসার্স সেন্টার এবং সরকারি অসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যারা প্রতিনিয়ত কৃষিকে আধুনিক এবং স্থায়িত্বশীল টেকসই করার লক্ষ্যে গরেষণা ও গুণগত মান বজায় রাখার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের নদীবিধৌত সমতল ভূমিতে পলি দোঁয়াশ মাটির আবাহিকায় সোনার ফসল ফলানোর মাধ্যমে বদলানো সম্ভব হতে পারে ১৮০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্যসমস্যা। একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কৃষি যন্ত্রাংশে নবনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিতে আনা যেতে পারে ব্যপক উন্নয়ন। যার ফলশ্রুতিতে আর কখনো খাদ্য ঘাটতি না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন ও উন্নত বীজগুলি সংরক্ষণ করতে হবে। খুব ধীরে ধীরে সনাতন বীজগুলি হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার রোকালয় বা জনপদ থেকে। জীববৈচিত্র রক্ষা করতে পারলে বিশেষ করে ব্যঙ, কাঁকড়া, ঘাস ফড়িং। এগুলো ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়গুলি খেয়ে জমিতে ভালো ফসল ফলানোতে সহযোগিতা করে। আমরা ভালো ফলাফলের জন্য জমিতে প্রচুর কীটনাশক ও সার ব্যবহার করছি। যাতে করে জমিতে ফলন হচ্ছে বেশি কিন্তু ফসলে স্বাদ-গন্ধ তেমন একটা কিছুই নেই। জমিতে বেশি বেশি ছাই ও জৈবসার ব্যবহার করলে জমির উর্বরতা যেমন করে বৃদ্ধি পাবে তেমনি করে ফসলের ফলন ও মান বৃদ্ধি পাবে। আমাদের এক ধরণের ধারণা আছে কৃষিজমিতে চাষাবাদ করলে লোকজন কৃষক বা চাষা বলে থাকে। গায়ে চাষার লেবাস লেগে যাবে তাই আমরা শিক্ষিত মানুষজন কৃষিভূমিতে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে থাকি। আমাদের সন্তান-সন্তুতি ও তরুণ-তরুণীদের মাঠে কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে হবে।

প্রায়শঃ আমাদের ভোক্তা সাধারণদের মাঝে একটি কথা বেশি প্রচলিত হয়। আমরা যা-ই খাচ্ছি সব-ই বিষ খাচ্ছি। ইদানিং দেখা যাচ্ছে সাপ্লায়ার বা বিক্রেতারা খরিদ্দার বা ক্রেতা সাধারণদের হাতে যাই তুলে দিচ্ছে তাতেই বিষাক্ত পিজারবেটিব, ফরমালিন, কার্বাইড এর মতো বিষাক্ত ক্যামিক্যাল ব্যবহার করছে। এমনকি মুরগীর খাদ্যেও রয়েছে বিষাক্ত পদার্থ গরুর চামড়ার এক ধরণের গুড়ি বা পাউডার যা কিনা মানব শরীরে দীর্ঘদিন পর ক্যান্সার বা অন্যান্য জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। বিক্রেতারা ক্রেতাদের সঙে এক ধরণের প্রতারণা করছে। এই ধরণের প্রতারণা বন্ধ করে সঠিক সুন্দরভাবে ন্যায় ও নীতির মাধ্যমে কৃষিসম্পদ পরিচালিত করতে পারলে বাংলাদেশ পাল্টে যাবে খুব শীঘ্রই। আমাদের দেশের তরুণসমাজ এখন পশ্চিমা দেশের আদলে চলাফেরা ও নগরায়ন সভ্যতার প্রতি বেশি ঝুঁকে আছে। গ্রামের মাঠ-প্রান্তর এখন কমে আসছে খুব ধীরে-ধীরে। একন সেখাসেও বিভিন্ন মিল কারখানা করে নগরায়ন সভ্যতার প্রতি বেশি ঝুঁকছে। কাটছে গাছপালাপ। ধ্বংস করছে জীববৈচিত্র ও চারপাশের প্রকৃতি ও কৃষিজ ভূমি। একসময় সেখানে জলাশয় ও পুকুর দেখা যেতো এখন সেথানে হাইরাইজড বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে।

আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ খুবভাবে প্রচলিত আছে। “বাড়ির গরু ঘাটার ঘাস খায়না। আমাদের কিছু নিরক্ষর ও কমশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছে যারা দেশে নিজের জমিতে কাজ করতে পারে। এবং যাদের জমি জিরেত আছে তাদের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিজ কর্মকান্ড পরিচালনা করে দেশীয় উন্নয়নে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তাদের দেখা যায় বাড়ির বা জমির কিছু অংশ বিক্রি করে বৌ-বাচ্চাকে বাবা-মা বা আইনগত অভিভাবকের কাছে হাওলা করে দিয়ে বিদেশে চলে যায়। বিদেশে রোগে-শোকে অযত্নে-অবহেলায় কিছুদিন থেকে অসুস্থ হয়ে আবার গ্রামে এসে মানুষের দরবাবে দরবারে ভিক্ষুক বা ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। অথচ দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের মাইলফলকের দিকে এগুচ্ছে। তবে আমাদের মানসিকতা বদলালে এই ছোট্ট বদ্বীপটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের মধ্যে যারা মেধাবী বা বড়বড় চাকরি করে তারা দেশের বড়বড় শহরগুলিতে তাদের সন্তানদের পড়ালেখা বা মানুষ করতে থেকে যায় বছরের পর বছর। এবং অনেকেই সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে এদেশের রাজধানী শহর বা নগর-বন্দরে থেকে গ্রামীণ জনপদকে কুন্ঠিত করছে। গ্রাম বা কৃষির প্রতি যদি আমরা একটু যত্ন দিই তবে সত্যিই কৃষি হবে একদিন এই সোনার বাংলার জাগরণ।

আমাদের দেশের মেধাবী ও দক্ষ যুবক সমাজকে ব্যবহার করে এবং ডিজিটাল বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে একসময়ে দেশের দুঃখ জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করে বাংলাদেশ খুব সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে কৃষকসমাজ এবং কৃষিখাতের উন্নয়নে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের অবিস্মরণীয় অবদান। সরকার এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ক্ষুধার্ত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্যান্নোয়ন করে যাচ্ছে কার্যকরভাবে। বাংলাদেশ সরকার রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের জন্য কৃষি উন্নয়নে সরকারের কৃষি-সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরকে তথ্য প্রযুক্তি ও ই-কৃষি সেবার আওতায় এনে কৃষিখাতে ব্যপক উন্নয়ন করেছে। কৃষি সেক্টরে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এদেশের সকল সচেতন মানুষ প্রতিটি কৃষিভিত্তিক জায়গাকে উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিখাতে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। যা প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য গোলা ভরা ধান আর ফসল ভরা মাঠ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এ বাংলার বুকে ফিরে আসছে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ‍ডিজিটাল বিপ্লবের কল্যাণে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে ওঠার দিন আসছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক।

Print Friendly

Related Posts