যীশু খ্রীষ্টের জন্ম: মানব মুক্তির প্রকাশ

শৌল বৈরাগী

আজ থেকে কম-বেশ ২ হাজার বছর পূর্বে ইস্রায়েল দেশের যুদেয়া প্রদেশের নাসারত গ্রামের একটি ছোট গোয়াল ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন পৃথিবীর ত্রাণকর্তা প্রভু যীশু খ্রীষ্ট। তখন ইস্রায়েল দেশটি রোম সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। আর ইস্রায়েলের রাজা ছিলেন হেরোদ। তখন রাজ্যময় ঘোষণা করলেন যে দায়ূদ বংশের লোক গণনা করা হবে এবং সবাইকে নিজ নিজ শহরে এসে এই লোক গণণায় (আদম শুমারীতে) অংশ নিতে হবে এবং নাম লেখাতে হবে। যীশুর মা মারিয়ার বাগদত্তা যোষেফ ছিলেন দায়ুদ বংশের। তাই তাদেরও নাম লেখাতে বেতলেহেম নগরে আসতে হয়েছিল। তিন দিনের পথ পাড়ি দিয়ে যীশুর মা মারীয়া এবং যোসেফ যুদেয়ার বেতলেহেম নগরের নাসারত গ্রামে পৌঁছায়। আর তখনই মারীয়ার প্রসব বেদনা উপস্থিত হয়। কিন্তু নগরে এত ভীড় ছিল যে তাঁরা কোথাও কোন বাড়ীতে বা সরাই খানায় (পান্থশালায়) জায়গা পেল না। এদিকে মারীয়ার প্রসব বেদনা বেড়েই চলছে এবং যীশুর জন্ম সময় সন্নিকট হয়ে গেল। শেষাবধি কোন ঘর বা বাড়ী বা সরাই খানায় আশ্রয় না পেয়ে একটা গরুর বা গোয়াল ঘরেই মারীয়াকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন যীশুর পালক পিতা যোসেফ। আর সেখানেই জন্ম নিলেন মানুষের ত্রাণকর্তা ও মুক্তিদাতা রূপে ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র যার নাম যীশু। যীশু শব্দের অর্থ ইম্মানুয়েল বা আমাদের সাথে ঈশ্বর।

যীশু খ্রীষ্টের জন্ম যে হঠাৎ করে হয়েছিল তা কিন্তু নয়। এটা একটি ঐশ মহাপরিকল্পনা। যীশুর জন্মের বহু বছর আগে থেকেই ঈশ্বর মহাপরিকল্পনা করেছিলেন। যীশুর জন্মের প্রায় ৬শ’ বছর পূর্বে ইশাইয়া ভাববাদী ভাববানী করেছিলেন, ‘কারণ একটি বালক আমাদের জন্য জন্মিয়াছেন, একটি পুত্র আমাদের দত্ত হইয়াছে; আর তাঁহারই স্কন্ধের উপর কর্তৃত্বভার থাকিবে, এবং তাঁহার নাম হইবে-আশ্চার্য মন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ’। (যিশাইয়া ৯ঃ৬ পদ)

এমনি ভাবে আরো অনেক ভাববাদী যীশুর বিষয়ে বা তাঁর জন্মের বিষয় জন্মের বহু বছর আগে ভাববাণী করেছেন এবং যীশুর জন্মের মধ্যে দিয়ে তা পূর্ণতা পেয়েছে। যীশু ঈশ্বরের পুত্র। ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্রকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষের পাপ থেকে মুক্তির জন্য; মানুষের পরিত্রাণের জন্য। যীশুর জন্মের পূর্বে মানুষ নানা পাপ কাজে লিপ্ত ছিল, ঈশ্বরের নির্দেশিত পথ থেকে দূরে সরে গেছে। ঈশ্বরের নিজ প্রতিমূর্ত্তিতে এবং ভালবাসার মানুষ পাপের পথে চলে গেছে, পঙ্কিলতায় ভরে গেছে, তাঁরা ঈশ্বরের প্রদর্শিত পথ থেকে দূরে চলে গেছে এটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তিনি ইস্রায়েল জাতিকে পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাঁর একমাত্র পুত্রকে মানুষ রূপে এ পৃথিবীতে পাঠালেন। তাই তিনি যুগে যুগে অনেক ভাববাদী বা ধর্মগুরুদের পাঠিয়েছেন মানুষের মন পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু মানুষ তাঁদের অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁদের কথা শুনে নাই। তাইতো ঈশ্বর পরিকল্পনা করলেন তাঁর একমাত্র পুত্রকে এ জগতে পাঠাবেন মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে, মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করতে। তাঁর জন্ম, শিক্ষা, উপদেশ, ঐশবাণী প্রচার, মানুষের মন পরিবর্তনের জন্য ঘোষণা, ক্রুশীয় মৃত্যু এবং পুনুরুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তি পাবে; পরিত্রাণ পাবে এমনটাই পরিকল্পনা করেন স্বয়ং ঈশ্বর। আর এ জন্য বহু যুগ বা শতাব্দীর প্রস্তুতি শেষে তাঁর একমাত্র পুত্রকে ঐশ আশীর্বাদে মারীয়ার গর্ভের মাধ্যমে ঈশ্বর হয়েও এ পৃথিবীতে মানুষের সমস্ত সত্ত্বা নিয়ে এলেন, মানুষের সাথে থাকলেন এবং মানুষের পাপ থেকে মুক্তির দায় নিজের কঁধে নিলেন।

যীশুর জন্মের সংবাদে তখনকার রাজারা ভয় পেয়ে গেলেন। রাজারা মনে করলেন তাঁদের পৃথিবীর রাজ্য দখল করতেই তিনি পৃথিবী আসছেন। আসলে তিনি রাজা হিসেবেই এসেছেন তবে কোন দেশ বা কোন ভৌগোলিক এলাকার রাজা হিসেবে নয় বরং ঐশ রাজ্যের রাজা হয়ে আসলেন। আর রাজারা যেহেতু এ পৃথিবীর রাজত্বের কথা ভেবেছেন তাই রাজারা যীশুর জন্ম সংবাদে মোটেই খুশী ছিলেন না। উল্লেখ আছে যে, রাজা হেরোদ সমস্ত বেতলেহেমের তিন বছর বয়সের কম সব শিশুদের হত্যা করেছেন যেন যীশু মারা যায়। যীশুর জন্মও মানব জাতির জন্য এক ঐশ্বরিক মহাআশীর্বাদ ও রহস্য। মারীয়ার গর্ভে যীশুর জন্ম হলেও কোন পুরুষের সংস্পর্শে তিনি আসেননি। যোসেফের সাথে কেবলমাত্র বাগদত্তা হয়েছিল। তাঁর গর্ভের সন্তান এসেছিল পবিত্র আত্মার প্রভাবে যা মহাদূত গাব্রিয়েলের মাধ্যমে কুমারী মারীয়ার কাছে এ সুসংবাদ পাঠানো প্রকাশ করা হয়। আর বার্তাটি ছিল ‘অয়ি মহানুগৃহীতে, মঙ্গল হউক; প্রভু তোমার সহবর্ত্তী। — মারীয়া ভয় করিও না, কেননা তুমি ঈশ্বরের নিকটে অনুগ্রহ পাইয়াছ। আর দেখ, তুমি গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে, ও তাঁহার নাম যীশু রাখিবে। তিনি মহান হইবেন, আর তাঁহাকে পরাৎপর পুত্র বলা যাইবে; আর প্রভু ঈশ্বর তাঁহার পিতা দায়ুদের সিংহাসন তাঁহাকে দিবেন—।’ (লুক ১ঃ২৮)

এ বার্তা শুনে মারিয়াও তা সাদরে গ্রহণ করেন। যেহেতু মারীয়া যোসেফের সাথে বাগদত্তা ছিলেন, তাই যোসেফ যেন মারীয়াকে ভুল না বুঝেন এজন্য দূতের মাধ্যমে যোসেফের নিকটও বার্তা পাঠানো হয়। দূতের মাধ্যমে যোসেফের কাছে দর্শণে পাঠানো বার্তাটি ছিল ‘যোসেফ, দায়ূদ সন্তান, তোমার স্ত্রী মারীয়াকে গ্রহণ করিতে ভয় করিও না, কেননা তাঁহার গর্ভে যাহা জন্মিয়াছে, তাহা পবিত্র আত্মা হইতে হইয়াছে; আর তিনি পুত্র প্রসব করিবেন, এবং তুমি তাঁহার নাম যীশু (ত্রাণকর্তা) রাখিবে;—’। মথি ১ঃ ২০-২১)

তাই যোসেফও বিষয়টি বিশ্বাস সহকারে মেনে নিয়েছিলেন এবং মারীয়া ও যীশুর দায়িত্ব নিতে তিনি দ্বিধা করেনে নি। কুমারী মারীয়ার গর্ভে যীশু ধীরে ধীরে বাড়তে থাকেন।

সময়ের পূর্ণতায় ইস্রায়েলের যুদেয়া প্রদেশের বেতলেহেমে নগরের নাসারত গ্রামে একটি গোয়াল ঘরে মানুষের পাপের মুক্তিদাতা যীশু জন্ম গ্রহণ করেন। তখন ছিল প্রচন্ড শীত। যীশুর মা মারীয়া যীশুকে কাপড়ে জড়িয়ে গোয়াল ঘরে যাবপাত্রে শোয়ায়ে রেখেছিলেন যেন গরুর গরম নিঃশ্বাসে যীশুকে গরম রাখতে পারে। পৃথিবীর আধ্যাত্মিক রাজার জন্মের সময় এভাবেই প্রচন্ড শীত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। সেই শীতের রাতে একদল রাখাল পাহাড়ী এলাকায় রাতে মেষ পাহারা দিচ্ছিল। হঠাৎ তারা অন্ধকারের মধ্যে আলোয় ভরে উঠলেন এবং ভয় পেয়ে গেলেন। তাদের কাছে এক দূতের আগমন ঘটল। দূত জানালো, ‘ভয় করিও না, কেননা দেখ, আমি তোমাদিগকে এক মহানন্দের সুসমাচার জানাইতেছি; সেই আনন্দ সমুদয় লোকেরই হইবে; কারণ অদ্য দায়ূদের নগরে তোমাদের জন্য ত্রাণকর্তা জন্মিয়াছেন; তিনি খ্রীষ্ট প্রভু।’ (লূক ২ঃ ১১-১১পদ)

দূতের কথামত রাখালেরা তখনই বেতলেহেম নগরে গিয়ে যীশুকে দেখতে পেলেন এবং তারা প্রণাম করলেন। ইতিহাস বা বাইবেল মতে, রাখালেরাই প্রথম যীশুর নিকট গিয়েছিলেন তাঁকে সম্মান জানাতে। এরপর পূর্ব বা প্রাচ্য দেশের কিছু পন্ডিত আকাশে একটি নতুন তারা দেখতে পায় এবং জ্যোর্তিবিদ্যা বিশ্লেষণ করে জানতে পারেন যে পৃথিবীতে একজন নতুন রাজার আগমন হয়েছে। তিনি পৃথিবীর রাজা, তিনি অধিকর্তা, তিনি আধ্যাত্মিক গুরু এবং মানুষের মুক্তিদাতা। পন্ডিতেরা নতুন রাজাকে দেখতে, সম্মান দেখাতে ও পূজো করতে পূর্ব দেশ থেকে কিছু মূল্যবান উপহার স্বর্ণ, কুন্দ্র ও গন্ধরস নিয়ে ইস্রায়েল দেশে আসেন। আকাশের নতুন তারাটি তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে এবং যীশু যে জায়গাতে ছিলেন সেখানে গিয়ে যীশুকে দেখে তারা প্রনাম করে মূল্যবান উপহার প্রদান করেন।

উল্লেখ্য যে, পন্ডিতেরা যীশুর সাথে দেখা করার পূর্বে হেরোদ রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে নতুন রাজা কোথায় জন্মেছেন তা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু হেরোদ রাজা তা জানতেন না। তাই পন্ডিতদের অনুরোধ করেছিলেন তারা নতুন রাজার দেখা পেলে তাকে জানানোর জন্য যেন তিনি গিয়ে রাজাকে সম্মান দেখাতে পারেন। প্রকৃত পক্ষে রাজা হেরোদের মনে ছিল অন্য পরিকল্পনা। যীশুকে মেরে ফেলা। এমতাবস্থায় পন্ডিতের কাছে স্বর্গ থেকে বলা হলো তারা যেন নতুন রাজার বিষয়ে রাজা হেরোদকে কিছু না জানান। অন্যদিকে দূতের মাধ্যমে পন্ডিতদের হেরোদ রাজাকে কিছু না জানানোর জন্য বলা হয়। বাইবেলে উল্লেখ আছে যে, হেরোদ রাজা কোন ভাবে নতুন রাজাকে খুঁজে না পেয়ে পন্ডিতদের দেয়া তথ্য মতে বেৎলেহেমে তিন বছরের কম বয়সী সব শিশুকে মেরে ফেলা হয়েছিল এই ভেবে যে যীশুও যেন ঐ শিশুদের সাথে মারা যায়।

যীশুর জন্মের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের মহাপারিকল্পনা মানব জাতির পাপ মুক্তির কাজ শুরু হয়েছে। যীশুর জন্মদিন এখন পুরো পৃথিবীর জুড়ে পালন করা হয়। আর এ দিনকে বলা হয় বড়দিন। বড়দিনের এখন সামিষ্টিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। বাহ্যিক ভাবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের উপহার দেয়া, নতুন পোষাক পরা, ঘর ও গীর্জাগুলো সাজানো, কেক তৈরী, একসঙ্গে ভোজন, র্কীতন গান, সান্তা ক্লজ এর উপহার ইত্যাদি যেমন করা হয়, তেমনি আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি হিসেবে বড়দিনের পূর্বে চার সপ্তাহ ধরে মনকে প্রস্তুত করা হয় প্রার্থণা ও নানা ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আর এই অনুষ্ঠানাদি এবং ২৫ ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন পালনের মাধ্যমে ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে ঘটে মহামিলন-মানুষ পেয়েছে পাপমুক্তি। শুভ বড়াদিন।

শৌল বৈরাগী: লেখক ও উন্নয়ন কর্মী, ঢাকা।

Email: saul_boiragee@yahoo.com

 

Print Friendly

Related Posts