আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২২ ও কিছু ভাবনা

শৌল বৈরাগী

২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ শিক্ষার অবদান প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য দেশ দিনটিকে পালন করে আসছে। যদিও আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস খুব পুরোনো নয়। যেমনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস, বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস ইত্যাদি। প্রতিটি দিবসেরই একটা করে প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘পরিবর্তনশীল গতিপথ রূপান্তরিত শিক্ষা’। তাই এ বছরে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসকে নতুন ভাবে দেখতে ও ভাবতে হবে। আজ আমাদের গতিপথ বদলে গেছে। শিক্ষার স্বাভাবিক অবস্থা আর নাই। করোনা সবকিছু তো বটেই বিশেষ করে গোট বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ছাত্র-ছাত্রী ও শিশুরা শিক্ষা থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দূরে সরে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পুঁথিগত ও শিক্ষকের বাইরেও তাদের শেখার ক্ষেত্রসমূহ সীমিত হয়ে গেছে। এ অবস্থা আরো কতদিন চলবে তা অনিশ্চিত।

২০২২ এ করোনার মহামারি অভিঘাত জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে ১০ বছর পর বা ২০৩০ এর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং গুণগতমান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে অথবা শিক্ষা ব্যবস্থা আরো কতোটা দ্রুত হবে। তখন আমরা কোথায় থাকব? টেকসই উন্নয়ন বা এসডিজি ২০৩০ এর শিক্ষার সাতটি লক্ষ্যের নিরিখে শিক্ষার মাপকাঠি হতে পারে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ সরকার লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এসডিজি’র সাতটি লক্ষ্য এক নজরে দেখে নেয়া যাক যা রূপান্তরের সহায়ক।

(১) ২০৩০ এর মধ্যে ১২ বছর পর্যন্ত মানসম্মত প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা সমতার ভিত্তিতে সার্বজনীন হবে।
(২) প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশু অন্তর্ভূক্ত হবে এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তাদের প্রস্তুতি নিশ্চিত হবে।
(৩) যথার্থ মানের সাশ্রয়ী কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা ও বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষর সুযোগ নারী-পুরুষের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত হবে।
(৪) বেশীরভাগ তরুণ ও বয়স্ক বিভিন্ন পেশায় ও কাজে উচ্চমানের দক্ষতা অর্জন করবেন। যেখানে থাকবে সমস্য বিশ্লেষণ, সমাধান, বিচক্ষণ চিন্তা, সৃজনশীলতা, দলবদ্ধ কাজ এবং বক্তব্য প্রকাশ ও যোগাযোগ দক্ষতা।
(৫) শিক্ষার সব রকম বৈষম্য বিলুপ্ত হবে। লিঙ্গ, বয়স, মাতৃভাষা, নৃ-পরিচয়, বর্ণ-ধর্ম, সামাজিক-আর্থিক অবস্থান বৈষম্যের কোন কারন থাকবে না।
(৬) সব তরুণ ও বয়স্ক মানুষ ব্যবহারযোগ্য সাক্ষরতা ও গণনার দক্ষতা আয়ত্ব করবেন, যা আনুষ্ঠানিকভাবে মৌলিক শিক্ষা সমাপ্তির সমতুল্য হবে। সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা (প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা) কার্যক্রমের সুযোগ উন্মুক্ত হবে।
(৭) সবাই টেকসই উন্নয়নের জন্য জ্ঞান ও দক্ষতা এবং বৈশ্বিক নাগরিকত্ববোধের শিক্ষায় অংশ নেবে। এ জ্ঞান ও দক্ষতা, শান্তি, মানুষের অধিকার, ভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতি পরিচয়ের প্রতি সহনশীল ও সহমর্মিতা বিকাশের মূল্যবোধ ও আচরণ প্রতিষ্ঠা করবে।

আজ আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। কিন্তু এ সীমিত লেখার মধ্যে অনেক কিছুই বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে এ দিবসটিতে তেমন কোন কার্যক্রম বা প্রচারণা সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে খুব একটা নজরে আসে না। ২০১৮ সালে ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ঘোষণা হলেও আমাদের দেশে তেমন কোন গুরুত্ব বা এমন কোন কর্মসূচি চোখে পড়ে না বা পত্রপত্রিকাগুলোতেও তেমন আলোকপাত করতে দেখা যায় না। দিনটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে যেন দেশের সাধারন মানুষ শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে বুঝতে পারে।

বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ শিক্ষার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ রাখে। তারা মনে করে শিক্ষার জন্য ব্যয় অর্থই হলো বিনিয়োগ। ঐসব দেশগুলো তাদের শিক্ষার বিনিয়োগ থেকে যথেষ্ট রিটার্ন পেয়ে থাকে। তারা এসব বিনিয়োগের জন্য পেয়ে থাকে বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার, আবিস্কারক, সাহিত্যিক ইত্যাদি। তারা পরিণত হয় উন্নত দেশে। তাইতো আমাদের মতো তৃতীয় বা উন্নয়নশীল দেশ থেকে পড়ালেখা করার জন্য পাড়ি জমায় ঐসব দেশে। উন্নত বা জ্ঞান পিপাসু দেশসমূহ শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগ বা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বাজেট প্রণয়ণেও সরকারের কৃপণতা লক্ষ্য করা যায়। ইউনেস্কো শিক্ষা ক্ষেত্রে মোট বাজেটের ৬% বরাদ্দের প্রস্তাব করলেও আমাদের দেশসহ বহু দেশ শিক্ষার জন্য ২-৩ শতাংশ বা এরও কম বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বরাদ্দ ২ শতাংশ বা কখনো কখনো তারও নীচে থাকে। যেমন ২০১৯ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের মাত্র ১.৩%। আমাদের এসব রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয়গুলো যাঁদের ভাবা দরকার আশা করি তাঁরা মনোযোগ দিবেন।

আধুনিক শিক্ষার সাথে আমাদের দেশের শিক্ষার তেমন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যেই একটা অমিল অমিল ভাব। একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এ বিষয়ে যেন কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। আমাদের দেশে চার বছরে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কোন উন্নত বিশ্বে গেলে তা মূল্যায়ণ করে না। কমপক্ষে ২/১ বছর লস দিতে হয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ঝরে যায় মহামূল্যবান ২/১টি বছর। তারপর আস্তে আস্তে পশ্চিমা বা উন্নত দেশের লেখাপড়ার ধাঁচের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই কোন গবেষণা বা কারিগরি জ্ঞান বা দক্ষতার ক্ষেত্র। শুধুমাত্র কারণিক দক্ষতাই গড়ে উঠে।
শিক্ষার সাথে শিক্ষক কথাটি সরাসরি জড়িত। ভাল একজন শিক্ষক না হলে ছাত্রছাত্রী উপযুক্ত শিক্ষায় গড়ে উঠতে পারে না। আমাদের শিক্ষকদের দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে যথাযথ মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব এখনো বিদ্যবান। এখনো আমাদের দেশে সরকারি বিদ্যালয় বেসরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক অনেক কম।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা মনে করি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কেমন? কিভাবে চলছে? আজ এই আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস যখন পালন করা হচ্ছে তখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির অপসারণ এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর অপসারণ চেয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করছে, অনশন করছে। নিশ্চয় সেখানে এমন কিছু ঘটনা আছে যা ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে যেতে বাধ্য করেছে। আমাদের দেশের শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, দিতে হবে তাদের জীবনের নিরাপত্তা। এছাড়াও আমাদের দেশের ধনী ও গরীবের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার পার্থক্য বিদ্যমান। ধনীর ঘরের ছেলেমেয়েরা যে পরিবেশে শিক্ষা অর্জন করে; একজন গরীব বাবা-মায়ের সন্তান ঠিক বিপরীত পরিবেশেই শিক্ষা অর্জন করে। আর এই পার্থক্য সমাজের ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে।

মানুষকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা পড়ে যাচ্ছি পেছনে। আমারা আমাদের মানুষদেরকে (প্রজন্ম) কতটা মানুষ করতে পেরেছি তা উন্নয়নের সূচক বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসবে। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত বেকারা দেশের বাইরে গিয়ে উপযুক্ত ও মানসম্মত শিক্ষার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে, শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এসব কিছুর সাথে করোনাও এখনো বিদ্যমান। করোনা এখন শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। এ প্রতিকূলতা ও নিউ নরমাল পরিবেশের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সামনে আগাতে হবে। শিক্ষা যেন সমাজ ও রাষ্ট্রকে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং পরিবর্তিত গতিপথে স্থির থেকে যেন রূপান্তরিত রাষ্ট্র গড়তে পারে – আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২২ এ এমনটাই প্রত্যাশা করি।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী।

Print Friendly

Related Posts