বিপজ্জনক মাত্রায় ঢাকার বায়ুদূষণ

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

দ্যা ইকোনোমিস্ট এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রতিবছর বসবাস অযোগ্য শহর গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। দুঃখজনক ভাবে ঢাকা পৃথিবীর বসবাস অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বায়ু দূষণের দিক দিয়ে ২০২০ ও ২০১৯ সালের প্রতিবেদন শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে ২য় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা শহর। যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে আসে এই তথ্য।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে বায়ু দূষণ জনিত রোগে মারা যায় প্রায় ১ লক্ষ ৫৩ হাজার লোক। বিশ্ব ব্যাংক-২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু ঢাকায় ১০ হাজার মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যায়।

বায়ু দূষণের কারণ ও দূষণের উৎস –

বায়ু দূষণের প্রাকৃতিক কারণ গুলোর মধ্যে আবহাওয়া জনিত ও ভোগলিক কারণ উল্লেখযোগ্য। মানব সৃষ্ট কারণ গুলোর মধ্যে নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা অন্যতম কারণ। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ (৩০%) থেকে সবচেয়ে বেশী বায়ু দূষণ হয়। এছাড়া অন্যান্য উৎস গুলোর মধ্যে ইটভাটা ও শিল্প কারখানা (২৯%), যানবাহনের কালো ধোঁয়া (১৫%), আন্তঃদেশীয় বায়ু দূষণ (১০%), গৃহস্থালী ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষক (৯%) এবং বর্জ্য পোড়ানোর (৭%) কারণে বায়ু দূষণ হয়ে থাকে।

২০১৬-২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের গড় বায়ুমান সূচক –

বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্টান ক্যাপস কর্তৃক ২০১৬ হতে ২০২১ সালের অর্থাৎ গত ৬ বছরের জানুয়ারি মাসের বায়ুমান সূচক বা AQI এর তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালে এই ৫ বছরের থেকেও ২০২১ সালে গড় বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসে ২৫ দিনের গড় বায়ুমান সূচক ২১৯.৫২ তে এসে দাঁড়িয়েছে যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।

গবেষণায় তথ্য -উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আরো দেখা যায় যে, জানুয়ারি মাসে ঢাকার মানুষের একদিনের জন্যও ভালো বায়ু সেবন করার সৌভাগ্য হয়নি, বায়ুমান বেশিরভাগ সময় “অস্বাস্থ্যকর” থেকে “খুবই অস্বাস্থ্যকর” অবস্থায় ছিল।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, গত ছয় বছরের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ২% (৩৮ দিন) সময় ভালো বায়ু গ্রহন করে। তবে এক্ষত্রে ২৬% (৫১০ দিন) চলনসই মানের বায়ু, ২৯% (৫৭৭ দিন) সংবেদনশীল বায়ু, ২২% (৪৪৩ দিন) অস্বাস্থ্যকর, ১৯% (৩৮৫ দিন) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ২% (৩৭ দিন) দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহন করেন। ঢাকা শহরের তিনটি স্থানে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষন স্টেশনেও (ক্যামস) বায়ুর মান কয়েক গুন বেশী লক্ষ্য করা হয়েছে। সাধারণত শীতের মৌসুমে গড় বায়ুমান সূচক বৃদ্ধি দেখা যায়। ঋতুর দিক দিয়ে শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ঋতু তাই এই সময়ে ধুলোবালির পরিমানও বৃদ্ধি পায়। ইটভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে, বায়ুর দূষকগুলো প্রধানত আবাহাওয়ার উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। শীতকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকে। যার ফলে এই সময়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অন্যদিকে বর্ষাকালে ইট ভাটা গুলো বন্ধ থাকে, অন্যদিকে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যা দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনে, তাই, জুন এবং জুলাইয়ের মতো মাসে গড় বায়ুমান সূচক তুলনামূলক কম পাওয়া যায় সবগুলো বছরে।

২০১৬-২০২১ সাল পর্যন্ত দৈনিক ২৪ ঘন্টা ভিত্তিতে –

দৈনিক ২৪ ঘন্টা ভিত্তিতে ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের মান সবচেয়ে খারাপ অবাস্থানে থাকে রাতের বেলায়। স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণঅধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর তথ্য মতে, ঢাকা শহরে বিকাল ৪ টার পর থেকে বায়ু দূষণের মান খারাপ হতে শুরু করে এবং যা রাত ১১ টা থেকে ২ টা এই সময়ে মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। গত ছয় বছরে গড় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায় রাত ১ টার সময় বায়ুমান সূচক ছিল ১৬২ যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ।

ক্যাপস এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, রাত ১০ টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রচুর মালবাহী ট্রাক ঢাকা শহরে প্রবেশ করে যার কারনে এইসব যানবাহন থেকে রাতে প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এই ছাড়াও, ঢাকা শহরের রাস্তা গুলো রাতের বেলায় সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ঝাড়ু দেওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে যার কারনে বাতাসে ধূলাবালি উড়তে থাকে। রাতের বেলায় যেহেতু দিনের চেয়ে তাপমাত্রা কম থাকে সেহেতু ধূলাবালি বাতাসে বেশী সময় ধরে অবস্থান করে। রাত ৩ টার পর থেকে বায়ুর মানের উন্নতি হলেও আবার সকাল ৬ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত একটি ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। সকালের এই সময়ে অফিসগামী মানুষ এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপের কারণে এই অবস্থা পরিলক্ষিত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। দিনের তাপমাত্রা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকায় এবং ভাড়ী যানবাহনের প্রবেশ দিনের বেলায় বন্ধ থাকায় সকাল ১০ টার পর থেকে বায়ু দূষণ ক্রমান্বয়ে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত কম দেখা যায় এবং বিকাল ৪ টার পর বায়ুর মান খারাপ হতে শুরু করে।

২০২১ সালে ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ১০টি স্থানের বায়ু গবেষণার ফলাফল –

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২১ সালে ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের বায়ুর মান পর্যবেক্ষেণের লক্ষ্যে বায়ুতে বস্তুকণা২.৫ এর উপস্থিতির পরিমাণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে। সামগ্রিকভাবে দেখা যায় যে, ২০২১ সালে ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের বছরে গড়ে বস্তুকণা২.৫ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৬৩ মাইক্রোগ্রাম যা বস্তুকণা২.৫ এর বাৎসরিক আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় ৪.২ গুন বেশি। গবেষণা থেকে আরো দেখা যায়, ২০২১ সালে ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল তেজগাঁও এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম) এবং পরের অবস্থানে রয়েছে শাহবাগ এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)। তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায়, প্রত্যকটি স্থানের গড় বস্তুকণা২.৫ ছিল নির্ধারিত মানমাত্রার কয়েক গুণ বেশি।

গবেষণায় অনুযায়ী, আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এই এলাকা গুলোতে গড় বস্তুকণা২.৫ ছিল প্রতি ঘনমিটারে যাথাক্রমে ৫৭, ৬২, ৬০, ৬৩, ৫৯, ৬১,৬৬ এবং ৬৫ মাইক্রোগ্রাম এবং যা নির্ধারিত মান মাত্রার প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি। মাঠ পর্যবেক্ষনে দেখা যায় যে উক্ত এলাকা সমূহে এমআরটি ও বিআরটি প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান। মাস অনুযায়ী ১০টি স্থানের গড় বস্তুকণা২.৫ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে বস্তুকণা২.৫ ¬ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২ মাইক্রোগ্রাম যা জুলাই মাসে মাত্র ২৯.০১ মাইক্রোগ্রাম ছিল।

বায়ুদূষণ রোধে ১৫ সুপারিশমালা –

স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপঃ
১. শুষ্ক মৌসুমে সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এর সমন্বয়ে ঢাকা শহরে প্রতি দিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২. নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।
৩. রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. অবৈধ ইটভাটা গুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।
৫. ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপঃ
৬. সরকারী ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করতে হবে।
৭. ঢাকার আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
৮. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসাবে সেন্ড বক্ল এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
১০. সিটি গভর্নেন্স এর প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়ন মূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপঃ
১১. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষন স্টেশন (ক্যামস) এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।
১৩. সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
১৪. ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।

(বিপজ্জনক মাত্রায় ঢাকার বায়ুদূষণ: জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবীতে বাপার সংবাদ সম্মেলনে পঠিত)

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
এবং প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)

ই-মেইলঃ kamrul_sub@hotmail.com, dk@stamforduniversity.edu.bd

Print Friendly

Related Posts