ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, জাটকা ধরলে সর্বনাশ

কৃষিবিদ সামছুল আলম

নদীমাতৃক বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। বহুকাল আগ থেকেই বাঙালির ইলিশ প্রীতির কথা সুবিদিত। সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ দোপেয়াজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ভাজা, ভাপা ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, ইলিশের মালাইকারী- এমন নানা পদের খাবার বাংলাদেশে জনপ্রিয়।

বাঙালির নিজস্ব স্বাদ এবং ঐতিহ্যের অংশ ইলিশ মাছ নুডলস এবং স্যুপ আকারেও পাওয়া যাচ্ছে। স্বাদে গন্ধে বাংলাদেশের ইলিশ অতুলনীয়।

বাঙালির ঐতিহ্য ও গৌরবের এক অনন্য প্রতীক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু এ মাছ যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় এবং নিরাপদ আমিষ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

একক মাছের প্রজাতি হিসেবে দেশের মৎস্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে ইলিশ। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের শতকরা ১২দশমিক ২২ ভাগ আসে শুধু ইলিশ থেকে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ হাজার কোটি টাকারও উর্ধ্বে। এ ছাড়া বর্তমানে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশের বেশি অবদান রয়েছে রুপালি ইলিশের।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ইলিশের স্থানীয় নাম জাটকা । জাটকা মাছ ইলিশ মাছের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর। পরিযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ইলিশ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাসহ কতকগুলি বড় বড় নদীর উজানে গিয়ে স্রোত প্রবাহে ডিম ছাড়ে। ভাসমান ডিম থেকে রেণু বেরিয়ে এসব এলাকায় কিছুদিন থাকে এবং এখানেই খায় ও বড় হয়। ছয় থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে পোনার দৈর্ঘ্যে ১২-২০ সে.মি লম্বা হয়, তখন এদের জাটকা বলে।

বাংলাদেশের মৎস্য আইন অনুযায়ী পূর্বে জাটকার আকার ছিল ৯ ইঞ্চি। কিন্তু ২০১৪ সালে গেজেট সংশোধন করে ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের (ঠোঁট থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত) কম দৈর্ঘ্যের ইলিশকে জাটকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

ইলিশের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক অবস্থা ‘জাটকা’ রক্ষায় জনগণের মাঝে সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারো ৩১শে মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ- ২০২২ উদযাপন করতে যাচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ ,জাটকা ধরলে সর্বনাশ’।

বাংলাদেশে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৭ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। আজকের জাটকা আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা ধরা হলে পরিপক্কতা লাভের সুযোগ বিঘ্নিত হয়ে বড় ইলিশ পাওয়া যায় না ফলে পরবর্তীতে মা ইলিশ থাকেনা। বিধায় বংশবৃদ্ধির সুযোগ থাকেনা। প্রাকৃতিকভাবে মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার পর তা থেকে পোনা এবং পোনা থেকে জাটকা এবং পরবর্তীতে বড় ইলিশে পরিণত হয়।

একটি মা ইলিশ ২.৫ লক্ষ থেকে শুরু করে ২৩ লক্ষ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে অর্থাৎ একটি মা ইলিশ ধরলে ২৩ লক্ষ পোনা উৎপাদন বন্ধ হয়। জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরার কারণে ইলিশের উৎপাদন কমে যায়, ফলে জেলেদের উপার্জনও কমে যায়। তাই ইলিশের ভবিষ্যৎ উৎপাদন এবং জেলেদের উপার্জন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, প্রতিবছর ৮ মাস জাটকা ও প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন, সমুদ্রে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, বিশেষ কম্বিং অপারেশনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। দেশে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় ইলিশের মোট অভয়াশ্রম রয়েছে ছয়টি (পাঁচটিতে মার্চ-এপ্রিল মাছ ধরা বন্ধ, আন্ধারমানিক ব্যতীত), যার মোট আয়তন ৪৩২ কিলোমিটার। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত মোট ৮ মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এ সময় জাটকা ধরলে কমপক্ষে ১ বছর থেকে ২ বছরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।

চন্দ্রমাসের ভিত্তিতে প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরে প্রতিবছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার ৪ দিন আগে থেকে পূর্ণিমার দিনসহ পরের ১৭ দিন মিলিয়ে মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা, মজুদ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে। জাটকা যেন ইলিশ ধরার জালে আটকে না যায়, তাই সরকার ইলিশ ধরার ফাঁস জালের সাইজ ৬ দশমিক ৫ সে.মি নির্ধারণ করেছে।

ইলিশ রক্ষায় প্রতি বছর সাধারণত মার্চ বা এপ্রিল মাসে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করে সরকার। মৎস্য সম্পদ ধ্বংসকারী কারেন্ট জাল, বেহুন্দি ও অন্যান্য অবৈধ জাল নির্মূলে প্রতিবছর বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হয় মৎস্য অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থেকে। তাছাড়া জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সচেতনতামূলক টিভিসি, জিঙ্গেল, স্ক্রল , বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফোল্ডার, পুস্তিকা বিনামূল্যে প্রচার করে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের প্রচার সেল নামে পরিচিত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর।

দেশের প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে নিয়োজিত । ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে । এসব কর্মসূচির আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাটকাসমৃদ্ধ ২০ জেলার ৯৬টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ৩ লাখ ১ হাজার ২৮৮ টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য মোট ৪৬ হাজার ৭৮৮ দশমিক ০৮ মেট্রিক টন চাল প্রদান করা হয়েছে। গত ৮ বছরে জাটকা আহরণে বিরত ২০ লক্ষ ৯৫ হাজার ৬৮৫টি জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে ৪ মাস ভিজিএফ(চাল) বিতরণ করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময় ছাড়াও গত ৫ অর্থ-বছরে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন ২২ দিনের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে মোট ২৬ লাখ ২৯ হাজার ৫০৯ টি জেলে পরিবারকে ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং গবেষণা প্রকল্পের আওতায় মোট ৫৩ হাজার ৩০৯ জন সুফলভোগীকে জাটকা ও পরিপক্ক ইলিশ সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস- মুরগি পালন, গরু- ছাগল পালন , ভ্যান বা রিকশা, সেলাই মেশিন, ইলিশ ধরার জাল প্রদান , খাঁচায় মাছ চাষ ইত্যাদি আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য মতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওড়েও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।

এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লক্ষ মে.টন; ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে তা হয় ৩.৯৫ লক্ষ মে.টন, ২০১৬-১৭ সালে ৪.৯৬ লক্ষ মে.টন , ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫.৩৩ লক্ষ মে.টন এবং ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তা ৫.৫০ লক্ষ মে.টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৩.৯৫ শতাংশ-যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য।

মা ইলিশ ও জাটকা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের ফলে দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত এখন বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল অনেকাংশে অনুসরণ করছে। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
alam4162@gmail.com

Print Friendly

Related Posts