শরীফা বুলবুল
পৃথিবীতে কত যে ফুল ফোটে, কে তার খোঁজ রাখে। কত ফুল যে নীরবে ঝরে যায়, কে তা মনে রাখে। তবে অজস্র ফুলের মাঝে কিছু ফুলের হাসিতে হেসে ওঠে গোটা বাগান। সুবাসে ভরে যায় পুরো জনপদ। তেমন ফুলদের ঝরে যাওয়ায় মন উদাস হয়, ভারাক্রান্ত হয়, চোখ ভিজে যায়, পরিবার তছনছ হয়ে যায়। এমনই দুটি ফুল সাবরিনা খালেদ এ্যানি (২৪) আর সামিয়া খালেদ শ্রাবণী (১৮)। এক বৃন্তে যেন দুটি কুড়ি। তবে আকস্মিক এক অগ্নিঝড়ে ঝরে গেছে তারা। চিরবিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে হৃদপিণ্ডের মাঝে।
প্রতিদিন কত দুর্ঘটনা ঘটে, কত প্রাণ ঝরে যায়- সব ঘটনার কি আর পরিসংখ্যান থাকে। নিছক দুর্ঘটনা কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে কত প্রাণ যে অকালে ঝরে যায় তার কোনো ইতিহাস নেই। তবে আপন দুই বোন এ্যানি আর শ্রাবণীর ঝরে যাওয়া যেন অন্যরকম। অসতর্ক, দায়িত্বজ্ঞানহীন, উদাসীন সমাজে বেড়ে ওঠা প্রতিটি জীবন যে মৃত্যুর ফাঁদে আটকে থাকে তারই দৃষ্টান্ত এ্যানি আর শ্রাবণী।
সম্পর্কে ওরা আমার ভাগ্নি। দুর্ঘটনার খবর জানার পর ফুটফুটে দুই মেয়ের আদুরে মুখখানি মনে করে আঁতকে উঠেছি বার বার। হায় হায়, কী শুনছি, সে কি সত্যি! শুরু থেকেই এতবড় সর্বনাশের কথা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এখনও মানতে পারছি না। যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি। কতদিন ওদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ কত বড় হয়ে গেছে ওরা। বড় ভাগ্নি এ্যানি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে ইংরেজি সাহিত্য স্নাতকোত্তর করেছে। ছোটটা চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। সে আবার নাকি বিএনসিসিও করে।
ঘটনাটা গত ৩ ফেব্রুয়ারির সকাল ১০টার দিকের। চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানাধীন রাহাত্তরপুলের চান্দাপুকুর পাড় এলাকায় বিসমিল্লাহ টাওয়ারের পঞ্চম তলায়। সেদিন ওদের মা-বাবা, মানে আমার বোন ও বোন জামাই বাসায় ছিল না। শুনেছি, ঘটনার আগে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল বড় ভাগ্নি এ্যানি। চা তৈরির জন্য ঢুকেছিল কিচেনে। গ্যাসের চুলা ধরাতে গিয়ে যেই না ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়েছিল, তখনই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে। সারা শরীরে আগুন ধরে যায় ওর। অগ্নিদগ্ধ বড় বোনকে বাঁচাতে তাকে জাপটে ধরে বাইরে আনার চেষ্টা করেছিল ছোট ভাগ্নি শ্রাবণী।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি কারোই। ভয়ঙ্কর আগুনে পুড়ে যাওয়া দুই ভাগ্নিকে আশপাশের লোকজন মিলে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সহকর্মীদের সহায়তা চেয়ে আমিও দৌড় দিই বার্ন ইনস্টিটিউটে। দেখেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।
পরদিন মৃত্যুর প্রায় আট ঘণ্টা আগে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন বড় ভাগ্নি এ্যানি হঠাৎই চোখ খুলে বলে, ‘খালামনি, আমাকে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পেসসি খাওয়াবে। বড্ড খেতে ইচ্ছে করছে। বললাম, ‘না মা, এমন অবস্থায় তোমার ঠাণ্ডা খাওয়া চলবে না’। এ কথা শুনে ভাগ্নি বললো, ‘আমার কিন্তু সময় কম। পরে আর সময় পাবে না, মনে রেখ’। চিকিৎসক আমাকে ডেকে বললেন, আপনার ভাগ্নির অবস্থা ভালো নয়। যেকোনো সময় চলে যেতে পারে। অতৃপ্তি নিয়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে না! আমার বুক ফেটে কান্না এলো।
তিনদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে তুমুল লড়াই করলো ফুটফুটে বড় ভাগ্নি। সেদিন গভীর রাতে বাসায় চলে এলাম। ক্লান্তিতে সকালে ঘুম ভাঙছিল না। হঠাৎ বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে বোনের ফোন। ধরেই ওপার থেকে হাউ মাউ করে কান্নার রোল। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে এভাবেই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল বড় ভাগ্নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই যেন লাশ নিতে পারি সেজন্য দিনভর চললো চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানা আর শাহবাগ থানার চিঠি চালাচালি। এরপর ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে দৌড়াদৌড়ি। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যায় ভাগ্নির লাশ চট্টগ্রামে পাঠিয়ে টলমলে পা টেনে বাসায় ফিরলাম। পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙলো ভাইঝি সানজিদার ফোনে। বললো, আন্টি, শ্রাবণী নেই!
পর পর দুটি ফুলের ঝরে যাওয়া মেনে নেয়া যায় না। শোকে আমার কান্না, আবেগ, অনুভূতি জমাট বেঁধেছে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশে আমাদের ফতেনগর গ্রামটি এখন স্তব্ধ। কান্না ভুলে গেছে স্বজনরা। চোখের মণি মেধাবী এ্যানি আর শ্রাবণীর মৃত্যুতে হঠাৎ হঠাৎ মূর্ছা যাচ্ছে বোন শারমিন আর বোন জামাই আলাউদ্দিন। ভাগ্নিরা তাদের বাবা মাকে কথা দিয়েছিল, লেখাপড়া শেষে পরিবারের হাল ধরবে। শ্রাবণীর স্বপ্ন ছিল বিশ্বব্যাংকে চাকরি করার। সব স্বপ্ন পুড়ে আজ ছাই।
আলাউদ্দিন গত ৫ জানুয়ারি চন্দনাইশের জোয়ারা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পুনঃনির্বাচিত ইউপি সদস্য। মেয়েদের হারিয়ে নির্বাচনী জয়ের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে। বাসায় গ্যাসের লাইনে লিকেজের কথা বাসাওয়ালাকে আগেই জানিয়েছিল আলাউদ্দিন। তবে গ্রাহ্য করেনি বাসার মালিক। বিষয়টাতে যদি গুরুত্ব দিতো আজ তাহলে এমন দুর্ঘটনা কি ঘটতো?
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্যাসের লাইনে লিকেজ অথবা চালু থাকা চুলা থেকে নির্গত গ্যাস জমেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। শুধু বোনের বাসাটাই নয়, বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আশপাশের আরো দুটি বাসার দরজা-জানালাসহ আসবাবপত্র বিধ্বস্ত হয়েছে।
কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে, আমার ফুটফুটে দুই ভাগ্নিকে খুন করা হয়েছে! আর এই খুনের পেছনে রয়েছে বাসার মালিকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, উদাসীনতা আর অসর্তকতা। এভাবে আর কত এ্যানি, শ্রাবণীকে হারাবো আমরা। আমাদের কি কোনো বোধদয় হবে না?
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ঢাকা।