৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মো. নাজমুল হক

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সুদক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তিনি শাসক ও শোষিতের অন্তরের কথা বুঝতেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করা বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবন প্রতিনিয়ত ভাষণ, বক্তৃতা, সভা সমাবেশের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন।জনগণের আত্মার সাথে তার ছিল দৃঢ় সম্পর্ক। তিনি জনগণের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতেন। বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্থান করে নেয়া এক মহাকাব্যের নাম ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। একজন রাজনীতির কবি (নিউজ অব ম্যাগাজিনের ভাষায় “পোয়েট অব পলিটিক্স”) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণের প্রণেতা। ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখ লাখ মানুষের উপস্থিত সমাবেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। শোষণ-বঞ্চনার ও পরাধীনতার শিকলে বন্দি জাতিকে মুক্ত করার মহান প্রয়াস ছিল এই ভাষণ। ঐতিহাসিক এ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েই আপামর নিরস্ত্র জনতা সশস্ত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাঁর এ ভাষণে ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা অবহেলা এবং পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তিলাভের যে ব্রত সবকিছুই ছিল এ ভাষণে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেছিলেন ২টা ৪৫ মিনিটে এবং শেষ করেছিলেন বিকাল ৩টা ০৩মিনিটে। তার এই ১৮ মিনিটের ভাষণই উদ্দীপ্ত করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্নকে। ১৯৭১ সালে জেগে উঠেছিল সমগ্র বাংলার মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান ছিল এ ভাষণ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক গভীর। ভাষণটির প্রেক্ষাপট ছিল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে জয়লাভ করেও আওয়ামী লীগ গদিতে বসতে পারে নাই।এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এ সিদ্ধান্তকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের স্বৈরাচারী মনোভাব বলে আখ্যায়িত করেন। যার রেশে সারাদেশের মানুষ ২ মার্চ এবং ৩ মার্চ সমগ্র বাংলায় হরতাল পালন করে। এর পর প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার ডাক দেওয়া হল “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। অতঃপর অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

মূলত এরপর সমগ্র বাংলার মানুষ ৭ই মার্চের ভাষণের অপেক্ষায় ছিল। ৭ ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ দফা দাবি পেশ করেনঃ ১.সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, ২.সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, ৩. গণহত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে এবং ৪. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে যুদ্ধের ঘোষণা এবং জয়ী হওয়ার কৌশল ও বাতলে দেওয়া হয়েছিল। এ ভাষণের মাধ্যমে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে কাজ করে ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ১৮ মিনিটের এ ভাষণ এর প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। এ ভাষণকে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কে বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থাটির মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।

আজ আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব। পেয়েছি লাল সবুজের সোনার বাংলাদেশ যা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। যতদিন লাল-সবুজের এই বাংলা থাকবে ততদিন এই বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকবে। তাইতো কবি বলেছেন-

“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”।

লেখক: হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, বিআইএ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts