মো. নাজমুল হক
বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় এক দিন ২৬ মার্চ।এ দিনটিই আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় বাঙালি জাতি পেয়েছে স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫১ তম বার্ষিকী এ বছর। ইতিহাসের এই দিন বাঙালির অবিস্মরণীয় এক গৌরব গাঁথার দিন। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে লাল সবুজের পতাকা উড়ানোর দিন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের সংবিধানের উপক্রমণিকায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইবার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
রক্তপাতহীন স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহিত ঢাকায় আলোচনায় বসেন। আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ইয়াহিয়া পাকিস্তানে ফিরে যান। এরপর পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচালিত অভিযানে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালায়। এ অপারেশনে তাদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন যে কোনো মূল্যে দমনসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তার করে পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করা। গণহত্যা চালানোর পর সেই রাতেই পাকিস্তানি সেনারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর বিশ্বস্ত পাঁচজন সহকারীকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই আপনারা যে যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা পত্রটি ২৬ ও ২৭ তারিখে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বেশ কয়েকজন তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। পরবর্তীতে তাঁর এই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তৎকালীন সময়ের কঠিন বাস্তবতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণার এই নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খন্ডে বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা উল্লেখ করা হয়।
এ বছর একসঙ্গে গোটা জাতি উদযাপন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী যা গত বছর শুরু হলেও করোনা অতিমারির জন্য উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করেছে যাতে শেষ সময়ের অনুষ্ঠানগুলো আরো জাঁকজমকভাবে পালন করা যায়।
দিবসটিকে ঘিরে প্রতীকী ব্ল্যাক আউটসহ পতাকা উত্তোলন, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা সেমিনার ও মসজিদ মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে। এ দিন কে ঘিরে পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে এবং বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে থাকে।
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ‘ এর জন্য এ বছর নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও দুইটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পুরস্কার পদক তুলে দেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এ পুরস্কার দিয়ে আসছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে দেশে মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু টানেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পথচলাসহ তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে উন্নয়নের এক রোল মডেলে পরিণত হয়েছে দেশ। কৃষি, বিদ্যুৎ এবং ডিজিটাল খাত এগিয়ে চলছে সমানতালে। বাংলাদেশ ৫৭ তম দেশ হিসেবে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ উৎক্ষেপণ করেছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন দারিদ্র্যের হার ছিল ৯০ শতাংশ যা বর্তমানে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে এবং মাথাপিছু আয় ২,৫৯১ মার্কিন ডলার।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।এইদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক- অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া গৌরবময় স্বাধীনতাকে যেকোনো মূল্যে অক্ষুন্ন রাখতে হবে। মহান স্বাধীনতা দিবসের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা তথা সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে তাঁর কাঙ্খিত গন্তব্যে।
লেখক: কলামিস্ট ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, বিআইএ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়।