মো. নাজমুল হক
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। এই মঙ্গল কামনায় শুরু হলো পহেলা বৈশাখ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে ১৪২৮ বঙ্গাব্দকে বিদায় দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বছর ১৪২৯। এ দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকে। এটি বাঙালির একটি সার্বজনীন লোক উৎসব। কৃষিকাজ কে প্রাধান্য দিয়ে দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছর শুরু হয়। নতুনদিনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা থাকে সুখী হবার।এক সময় বাংলা নববর্ষের মূল ভিত্তি ছিল হালখাতা অনুষ্ঠান। আর এটি পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে।মোঘল সম্রাট আকবর কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনা শুরু করেন।বাংলা নববর্ষের প্রারম্ভে ব্যবসায়ীরা গ্রামে গঞ্জে শহরে ব্যবসায়ের পুরাতন হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। আর এ উপলক্ষে তারা তাদের খদ্দেরদেরকে হালখাতার কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি খাওয়াতেন এবং নবরূপে ব্যবসায়িক যোগসুত্র স্থাপন করতেন। কালক্রমে এ অনুষ্ঠানটি আজও বিদ্যমান।
এক অমলিন আনন্দের দিন পহেলা বৈশাখ। একটি নতুন সূর্যের আলোয় সারাবিশ্বের বাঙালিরা জেগে উঠবে এ দিন। ধনী-গরিব, ধর্ম – বর্ণ সকল বিভেদ ভুলে সর্বস্তরের মানুষ এদিন উৎসবে মেতে উঠবে। সারা বিশ্বের কাছে বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে তুলে ধরবে তার আপন ঐতিহ্য বাঙালিয়ানা ও নিজস্ব সংস্কৃতি।
গতবছর করোনা অতিমারির প্রকট থাকায় প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হলেও এবছর করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) থেকে বের হয়ে শোভাযাত্রা স্মৃতি চিরন্তন হয়ে পুনরায় টিএসসিতে গিয়ে শেষ হবে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নির্মল করো মঙ্গল করো মর্ম মুছায়ে’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রথম ১৯৮৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়।২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রা কে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। এদিকে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে তারই ধারাবাহিকতায় এদিন রাজধানীর রমনায় নব আনন্দে জেগে ওঠার প্রেরণা নিয়ে পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতী অনুষ্ঠান আয়োজন করবে ছায়ানট।
ধর্ম-বর্ণ ধনী-গরিব সবার তথা বাঙালি জাতির উৎসব পহেলা বৈশাখ। করোনা অতিমারির ধকল কাটিয়ে এবারের নববর্ষ উন্মোচন করবে নতুন দিগন্ত। এদিন জাতি হিসেবে আমরা সকল দ্বিধা বিভেদ ভুলে এক হব অখণ্ড জাতীয় চেতনায়। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে নারীরা পরবে লাল সাদা শাড়ি, খোপায় ফুল, হাতে চুড়ি এবং কপালে টিপ। আর ছেলেদের পরনে থাকবে বাহারি পাঞ্জাবি, ফতুয়াসহ মাথায় লাল গামছা।
এদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সকাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপিত হবে। নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সার্বজনীন লোকজ মেলা। দিবসটি উপলক্ষে গ্রামে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা,কুস্তি খেলা, বউ মেলাসহ আয়োজন করা হয়ে থাকে নানা রকম অনুষ্ঠানের। এদিন মানুষ নতুন জামা কাপড় পরে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেড়াতে যায় এবং বিশেষ খাবার খেয়ে থাকে। এই দিনে পরিবারের সাথে কিশোর-কিশোরীরাও বের হয় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জানতে। পহেলা বৈশাখ কে কেন্দ্র করে রেডিও টিভি চ্যানেল গুলো তে প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এছাড়াও সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি,ছায়ানট বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, নজরুল একাডেমী সহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এই দিনে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমারা একত্রে পালন করবে বৈসাবি উৎসব।
বাঙালির জীবনে নববর্ষ উদযাপন এর সঠিক গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে বাঙালি জাতি পুরাতন ক্লেদ, গ্লানি এবং জীর্ণতাকে দূরে ঠেলে নতুন জীবনের আশায় বুক বাঁধে, বরণ করে নববর্ষকে। পুরাতন সকল অশুভ কে পেছনে ফেলে আমাদের সবার জীবনে বয়ে আসুক সুখ শান্তি আর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাক সমানতালে নববর্ষে এই হোক আমাদের ব্রত।
কবি কথায়ঃ ‘নিশি অবসান প্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত। আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত। বন্ধু হও শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও, ক্ষমা করো আজিকার মত পুরাতন বছরের সাথে পুরাতন অপরাধ যত’।
নববর্ষের শুভেচ্ছা ঘ্রাণ সকলেই পাক। এসো হে বৈশাখ; নিরন্তর চাওয়া হে।
লেখক: কলামিস্ট ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (বিআইএ), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়।