পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের একুশ বছর পূর্ণ

পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের একুশ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভিত স্থাপন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন মাওয়া প্রান্তে এক সুধী সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন।

পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ।

এ ছাড়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উপলক্ষে সেদিন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে, সেখানেও ছাপা হয় ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী।

ভায়াডাক্ট ছাড়া ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে নিজের সক্ষমতা জানান দিয়েছে বাংলাদেশ। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৫ জুন সেতুটির উদ্বোধনও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থাৎ তিনি শুরু করেন এবং তিনিই শেষ করেন। এর এভাবেই আমরা পেলাম স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৮ সালে পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে ফরিদপুরের একটি জনসভায় প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণে কথা বলেন। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে জাপানিদের সঙ্গে অর্থায়নের বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা সাপেক্ষে সমীক্ষা হয়। সমীক্ষা যাচাইয়ের পর ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তার কয়েকদিন পরই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এ কাজ আর এগোয়নি। সেতুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে।

পরবর্তীতে ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবান করে। ২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে। বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করলে নতুন করে আশা জাগে। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়ে সেতুর ভবিষ্যৎ।

২০১২ সালের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জুলাই আবারও সংসদে দাঁড়িয়ে ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে’ বলে জানিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ জাতির সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি।

এরই মধ্যে ২০১৩ সালে বিশ্বকে অবাক করে বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। পরের বাজেটেই সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দ করার কথা বলেন তিনি। অসাধ্য সাধনের দুরন্ত সাহসে সব অনিশ্চয়তা দূর হয়। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এগিয়ে চলে কার্যক্রম।

২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলার জাজিরা পয়েন্টে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর অংশ দৃশ্যমান হয়। পরে একের পর এক ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়।

চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে কয়েক ধাপে সময় বাড়ানো হয়। কাজের মূল সময়সীমা ৪৮ মাস। বর্ধিত সময় ৪৩ মাস। ২২ জুন মূল সেতুর নির্মাণ কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

ভায়াডাক্ট ছাড়া ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে গৌরবের মালিক বাংলাদেশ।

জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৫ জুন সেতুটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সংগ্রামের ফসল পদ্মা সেতুর নাম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নামানুসারে করার দাবি উঠলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। বরং তার সিদ্ধান্তে সেতুর নাম ‘পদ্মা সেতু’ উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ হয়েছে।

 

পদ্মা সেতুর সম্পর্কে টুকিটাকি-

নকশা: পদ্মা সেতুর নকশা করেছে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল। ৬ ও ৭ নম্বর পিলার নিয়ে জটিলতা তৈরি হলেও পরে তা চূড়ান্ত হয়।

মূল সেতুর ঠিকাদার: মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)।

নদীশাসন: ১৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ করেছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন

প্রকল্পের মোট ব্যয়: পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

মূল সেতু নির্মাণে ব্যয়: ১২ হাজার ১৩৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা (৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার এবং গ্যাস লাইনের জন্য ১০০০ কোটি টাকাসহ)।

ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়: ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২৬ কোটি টাকা।

অন্যান্য ব্যয়: টোল প্লাজা এবং এসএ-২ সহ ১২ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোডের নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৯০৭ দশমিক ৬৮ কোটি টাকা (দুটি টোল প্লাজা, দুটি থানা ভবন এবং তিনটি পরিষেবা এলাকাসহ)। পুনর্বাসনে ব্যয় ১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। পরিবেশ রক্ষায় ব্যয় ১ হাজার ২৯০ দশমিক ৩ কোটি টাকা, কনসালটেন্সি ৬ হাজার ৭৮৩ দশমিক ৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য (বেতন, পরিবহন, সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স, ফিজিক্যাল এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি, ইন্টারেস্ট ইত্যাদি) ১ হাজার ৭৩১ দশমিক ১৭ টাকা।

পদ্মা সেতুর ধরন: দ্বিতলবিশিষ্ট। প্রধান নির্মাণ উপকরণ: কংক্রিট ও স্টিল। সেতুর দৈর্ঘ্য: ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ:৭২ ফুট।লেন: পদ্মা সেতুতে রয়েছে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার। পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট: ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার।

ভায়াডাক্ট পিলার: ৮১টি। পাইলিং গভীরতা:৩৮৩ ফুট। মোট পাইলিং:২৮৬টি। মোট পিলার:৪২টি। স্প্যান:৪১টি । পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছেন প্রায় চার হাজার মানুষ।

 

Print Friendly

Related Posts