ইসমাইল হোসেন শিরাজী : জাতীয় জাগরণের অগ্নিপুরুষ

নাজনীন মহল অঞ্জনা

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয় জাগরণের অগ্নিপুরুষ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। পরাধীনতার গ্লানি মুছে আত্মবিশ্বাস ও জাগরণের স্ফুলিঙ্গ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান একজন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বলেন, ‘হিন্দু মুসলমানের অন্তরে সমভাবে দেশপ্রেম সৃষ্টির কাজে যাহারা আমাদিগকে পথ প্রদর্শন করেছিলেন, নিঃসন্দেহে শিরাজী সাহেব তাঁহাদের অগ্রণী। আপনি ‘আচরি ধর্ম জীবেরে শিখাও’ এই কথা কয়টি শিরাজী সাহেবের জীবন সম্পর্কে নিখুঁতভাবে খাটে।’এক্ষেত্রে অবলম্বন ছিল তার কণ্ঠ আর কলম। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় অবিরাম বলিষ্ঠ লেখনী আর চারণের বেশে দেশময় অনলবর্ষী বক্তৃতা পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল।

-‘হেরি স্বাধীনতা দস্যু কবলিত
সাজিতেছে রুদ্রবেশে ক্রোধে উদ্বেলিত।…
এবার সে মহসিন্ধু প্রলয় গর্জনে
উঠিবে গরজি ঘোর প্রচণ্ড তর্জনে।…
বিতাড়িয়া দস্যুদলে সমুদ্রের পার
করিবে এবার তারা স্বদেশ উদ্ধার’
(অনল প্রবাহ ১৯০০ সাল)।

ভারতের স্বনামধন্য সাংবাদিক গবেষক ড. শিশির কর তার স্বদেশী যুগে কারাদণ্ডিত কবি শিরাজী’ গ্রন্থে মুখবন্ধে লিখেছেন-

‘… সম্পূর্ণ অসাস্মপ্রদায়িক মনোভাব নিয়ে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এমন বলিষ্ঠ লেখনী ধারণ করতে সে সময়কার কোনো মুসলিম কবিকে দেখা যায়নি। ওই সময়ের জাতীয়তাবাদী কবি ও লেখকদের মধ্যে অনল প্রবাহের লেখক শিরাজীর স্থান স্বতন্ত্র ও অনন্যও। আপোষহীন স্বাধীনতাকামী রাজনীতিক শিরাজী ছিলেন আজীবন কংগ্রেস রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

বলেন ‘‘ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাই-ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি নর-নারীর একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান ও চিন্তার বিষয় হউক। আমাদের কথার ভিতর দিয়া আমাদের কবিত্বের ভিতর দিয়া, আমাদের দর্শনের ভিতর দিয়া, আমাদের ধর্মের ভিতর দিয়া ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা সূর্য্যের ন্যায় উদ্দীপ্ত হউক।“

হতাশাগ্রস্ত পরাধীন জাতিকে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মন্ত্রণাদাতাকে ভুলতে বসেছি আমরা! তরুণ প্রজন্মের কাছে একেবারেই অচেনা-অজানা শিরাজী। এ ব্যর্থতা সমগ্র জাতির। মাত্র ৫১ বছর জীবনের অধিকারী ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষ জন্মেছিলেন সিরাজগঞ্জ শহরে ১৮৮০‘র ১৩ জুলাই।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ প্রকাশিত হয় ১৮৯৯ সালে (পুস্তিকা) ১৯০০ সালে (গ্রন্থ)। প্রথম কারাবরণ ১৯১০ সালে, কারা মুক্তি ১৪ মে ১৯১২ সালে, তুরস্কে যুদ্ধে গমন ২ ডিসেম্বর ১৯১২ সালে, যুদ্ধ ফেরত ১৩ জুলাই ১৯১৩ সালে।

শিরাজী ১৯২১ সালে খেলাফত ও অহিংস আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯২২ সালে মওলানা আকরম খাঁ কারারুদ্ধ হলে ৮ হাজার টাকা জরিমানার জন্য ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা বন্ধর বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে আবেদন ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় বক্তৃতা করে জনমত গড়ে তোলেন। ১৯২১ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে ৩টি সভায় সভাপতিত্ব করেন। ১৯২২ সালে কলকাতায় খেলাফত কমিটির সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা এবং আঙ্গোরায় দশ হাজার মুজাহেদীন পাঠানোর প্রস্তাব করেন। কাজী নজরুল ইসলাম ‘রণভেরী’ কবিতা লিখে তাতে সমর্থন যোগান।

১৯২৪ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সম্মেলনে সিরাজগঞ্জ কংগ্রেস সভাপতি শিরাজীকে বাদ দিয়ে অন্যকে সভাপতি করায় অসন্তুষ্ট মুসলমানেরা বঙ্গীয় মুসলিম মহাসমাবেশের আয়োজন করে এবং শিরাজী অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন।

১৯২৬ সালে দাদাভাই নওরোজের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন নীতি ত্যাগ করে সরাসরি স্বাধীনতা প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৯২৭ সালের ২৫ অক্টোবর মোসলেম তরুণ সংঘের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

১৯২৯ সালে প্রাদেশিক কাউন্সিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৩১ সালে লাহোরে তার নির্দেশে পুত্র আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী গান্ধী ডারউইন চুক্তির বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৯২৮ সালের ১৫ ও ১৬ আগস্ট কলকাতা আলবার্ট হলে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় কর্মী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

১৯৩১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হন। কারাগারেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ‘আমি মৃত্যুর মাঝে চিরদিন খুঁজি নবজীবনের সন্ধান’ – এই সত্যের সৃষ্টিকারী কিংবা উচ্চারক এই মহান মানুষটি ১৯৩১‘র ১৭ জুলাই পরলোক গমন করেন।

শ্রদ্ধা জানিয়ে পুত্র সৈয়দ আসাদউদদৌলা শিরাজীকে শোকবাণী প্রেরণ করেন মোস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক – ‘আমার পুরাতন বন্ধু মওলানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর মৃত্যুতে আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করিতেছি। তিনি কেবল যে ভারতের গৌরব ছিলেন তাহা নহে, তিনি ইসলাম জগতের নেতা ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে ইসলাম জগতে এক বিখ্যাত ব্যক্তির অভাব হইল। তুর্কীগণ আপনার শোকে সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছে। আপনার মত উপযুক্ত পুত্র রাখিয়া যাওয়াই তাঁহার গৌরব।… শোকে ধৈর্য্য ধারণ করুন।’
… (মাসিক প্রবাসী, ভাদ্র-১৩৩৮)

লেখক: ইসমাইল হোসেন শিরাজীর বংশধর

Print Friendly

Related Posts