প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাবিং, ভবিষ্যতের সুনাগরিক গড়ার প্রত্যয়

সাদিয়া জেরিন

 

শৃঙ্খলা, সেবা, আত্মবিশ্বাস, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃত্ব, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯০৭ সালে রবার্ট স্টিভেনসন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল (বিপি নামে জনপ্রিয়) স্কাউট আন্দোলন শুরু করেন।

স্কাউট বিশ্বব্যাপী একটি অরাজনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ, স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান স্কাউট আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য। নানাবিধ দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বীকৃতি এনে দেয় অপরিসীম আনন্দ যা একজন স্কাউটকে পরবর্তী স্তরে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

স্কাউট আন্দোলনের স্তর ৩টি। ৬-১০ বছর বয়সী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের কাব বলা হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ের ১১-১৭ বছর বয়সী ছাত্র ছাত্রীরা স্কাউট এবং উচ্চ মাধ্যমিক এবং তদুর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষার্থী যাদের বয়স ১৮-২৫ বছর পর্যন্ত তারা রোভার স্কাউট নামে পরিচিত। এছাড়া স্কাউটিং এর জন্য রেলওয়ে, এয়ার, নৌ অঞ্চলে চাকরিরতদের ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। আরও আছে মুক্ত দল।

ব্যাডেন পাওয়েল স্কাউট এবং রোভার স্কাউট আন্দোলন শুরু করার পর বিশ্বব্যাপী শিশুদের চেতনায় স্কাউটের ভাবনাকে পোঁছে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। “জাংগল বুক” নামক একটি বইয়ে নেকড়ে বাঘের দলের শৃঙ্খলা ও অন্য প্রাণীর গল্প থেকে ধারণা নিয়ে তিনি ১৯১৬ সালে কাব স্কাউট আন্দোলন শুরু করেন। মূলত “ঈঁন” হলো “শাবক” বা “বাচ্চা”। সম্পূর্ণ স্কাউট হওয়ার বয়স না হওয়ায় কাব স্কাউট হলো শিশু স্কাউট। “যথাসাধ্য চেষ্টা করো” এই মটো নিয়ে কাব স্কাউট স্রষ্টা ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে, প্রতিদিন কারো না কারো উপকার করতে এবং কাব আইন মেনে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই সাথে কাব আইনে বলা আছে বড়দের কথা মেনে চলা, নিজেদের খেয়ালে কিছু না করা।

কাব স্কাউটরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে হাতে কলমে কাজ করার মাধ্যমে শেখে। নির্ধারিত ইউনিফর্ম, ব্যাচ, স্কার্ফ পরিধানের মধ্য দিয়ে নিয়মানুবর্তিতার যে শিক্ষা পেয়ে থাকে তা তাদের ভবিষ্যৎ সৌজন্যবোধ, কর্মতৎপরতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস তৈরী করে। একজন কাব স্কাউট এ সকল গুণাবলির কারণেই সমবয়সী অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা চেতনাবোধ সম্পন্ন হয়। ভবিষ্যৎ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার বীজ বপন হয়ে যায় কাব স্কাউটিং এর মাধ্যমে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার প্রথম স্তর। কাব স্কাউটিং এর মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে আত্মনির্ভরশীলতা ও আনুগত্যের চর্চা শিশুদের দেশ ও জাতির কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করবে।

বৃক্ষরোপণ, সমাজ উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেবাদানের মত কার্যক্রমে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করার কারণে স্কাউট সর্বত্র প্রশংসিত। উপদলে বিভক্ত হয়ে কাজ করার যে ধারণা স্কাউট দেয় সেটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়। সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কোমলমতি শিশুদের মধ্যে ভাল কাজে আগ্রহ ও দেশাত্মবোধ সৃষ্টি করা যায়। নানাবিধ প্রশিক্ষণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাব শিশুদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, উন্নত চরিত্র গঠন এবং সেবাপরায়ণতা শেখায়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পূরক সহপাঠ্যক্রম হচ্ছে স্কাউটিং। মাদক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং এর মত সামাজিক সমস্যাগুলোর বিষয়ে প্রাথমিক স্তরেই কাব শিশুরা সচেতন হতে শেখে। বিভিন্ন কার্যক্রম, প্রশিক্ষণের স্বীকৃতি হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাব শিশুদের “শাপলা অ্যাওয়ার্ড” প্রদান করা হয় যা তাদের কাজের স্পৃহা বাড়ায় এবং পরবর্তীতে বৃহৎ অর্জনে কর্মোদীপ্ত করে।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিশুদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে কাব স্কাউটিং এর সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরী। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ স্কাউটস এর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কাব স্কাউটের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় কাবিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য ১১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। যার মধ্য দিয়ে ১১ হাজার নতুন কাব স্কাউট দল গঠিত হয়েছে।

এছাড়া স্কাউট শতাব্দী ভবন নির্মাণ, স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প সাইটের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কাউটিংকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে চিফ স্কাউট হিসেবে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং স্কাউটিং কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করেন।

বাঙালির ইতিহাস শৌর্য আর বীরত্বে গাঁথা। জাতির পিতা বলেছিলেন, “সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না” জাতি হিসেবে আমরা পিছু না হটে মাথা উঁচু করে কাঙ্খিত বিজয় অর্জন করেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই বিজয়ের মাহাত্ম্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি কাব স্কাউটিং এ উদ্বুদ্ধ করে তৈরী করতে হবে আগামীর দক্ষ, সফল নেতৃত্ব ।

সাদিয়া জেরিন: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

Print Friendly

Related Posts