মো. খবির উদ্দিন
মানব ইতিহাসের ভয়াবহ রক্তপাতের মধ্যে একটি হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যাকে ইংরেজিতে দ্য গ্রেট ওয়ার, ওয়ার অব দ্য নেশন্স হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে বলকান অঞ্চলে এই যুদ্ধের সূচনা হয়। আর শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর বেলা ১১টায়। পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশ থেকে ১৩ লাখ সৈন্য ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। তার মধ্যে নিহত হয় ৭৪ হাজার। এই যুদ্ধে এক পক্ষে ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া এবং অন্যপক্ষে ছিল রাশিয়া, সার্বিয়া, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রুমানিয়া ও মন্টোনিগ্রো। গবেষকরা এই যুদ্ধের পেছনের রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামরিক দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং উসমানি সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার কারণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেসব বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খতিয়ে দেখা হয় তা হলো- অমীমাংসিত ভূখন্ডগত বিরোধ, ইউরোপে ভারসাম্য বিধানকারী শক্তির পতন ঘটতে যাচ্ছে এমন ধারণা, শাসনব্যবস্থার জটিলতা ও ভঙ্গুরতা, কয়েক দশক ধরে চলা অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং সামরিক পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞরা কূটনৈতিক সংকট, উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তি, কূটনৈতিক বিভ্রান্তি ও যোগাযোগের সঙ্কটকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। ইউরোপীয় ও উপনিবেশ নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর (ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া) মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ১৯১৪ সালে এসে তাদের মধ্যকার উত্তেজনাকে ব্যাপক বাড়িয়ে তুলেছিল। এই সমস্ত কারণগুলোর আগুনে ঘি ঢেলেছিল ১৯ বছর বয়সি সার্বিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান গাভরিলো প্রিন্সিপের ছোড়া বুলেট। যে বুলেটে নিহত হন অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফি।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ৪ বছরেরও অধিক সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৯০ লাখ সামরিক এবং ১ কোটি ২০ লাখ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয় প্রায় ১ কোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লাখ সাধারণ মানুষ। চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান বা রুশ সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লাভিয়া, এস্তেনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ফ্যাসিবাদীরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহন করে। এ যুদ্ধের ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
ইউরোপ তথা বিশ্বের মানচিত্র পরিবর্তনকারী এই যুদ্ধে সৃষ্টি হয়েছে অনেকগুলো নতুন দেশ। জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা দায় নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই মনে করেন, একটি খুনের ঘটনা ঘিরে বেশ কিছু জটিল সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার জের ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ৬ কোটি ইউরোপিয়ানসহ ৭ কোটি সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তর এই যুদ্ধে একত্রিত হয়। এটি ছিল ইতিহাসের ভয়াবহ সংঘাতের একটি। এর ফলে পরবর্তী সময়ে এর সাথে যুক্ত দেশগুলোর রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন হয়। অনেক দেশে এটি বিপ্লবের সূচনা করে। তথ্যমতে এই মহাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরোক্ষভাবে ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপজুড়ে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক উত্থান হয়। তারা ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে যেকোনো মূল্যে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। মনে করা হয়, এই তীব্র জাতীয়তাবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একটি সাধারণ কারণ। যেমন ১৮৭০-৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধে জার্মানি ফ্রান্সকে পরাভূত করেছিল। জার্মানির কাছে ফ্রান্স বিপুল অর্থ ও ভূমি খুইয়েছিল। এ ঘটনা ফরাসি জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয় এবং জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের জন্য জনমত তৈরি হয়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপজুড়ে পুরোদমে শিল্পবিপ্লব চলছিল। তেল, গ্যাস, কয়লা ও আরও মূল্যবান খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ নতুন নতুন অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নতুন শিল্প ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন ৫টি মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল এবং আফ্রিকার অনেক উপনিবেশ যখন ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন, তখন উপনিবেশ স্থাপনের এই খেলায় জার্মানিও শরিক হতে চাচ্ছিল।
ঔপনিবেশক হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব আরও দৃঢ় করতে মরিয়া দেশগুলোর একে অপরের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েই চলছিল। সমমনা দেশগুলো তখন ইউরোপে নিজেদের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে একে অপরের সঙ্গে জোট (অ্যালায়েন্স) গঠন করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইউরোপের দেশগুলো তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে উদ্যোগী হয়। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ তাদের সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে দেয় যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সূচনাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। একইসঙ্গে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে নৌশক্তি স¤প্রসারণে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নৌ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নৌবাহিনী ছিল ব্রিটেনের। উত্তর সাগর ছিল জার্মানির একমাত্র উপক‚লীয় অঞ্চল, তবে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ নৌবাহিনী আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল।
উত্তর সাগরে শক্তিশালী ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য ১৮৯৮ সালে জার্মান সরকার নতুন নৌ আইন পাস করে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করে। জার্মানি তার নৌবাহিনী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে এবং নৌবাহিনীতে ১৭টি নতুন যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করে। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীতেও ১,৭০,০০০ নতুন সৈন্য অন্তর্ভুক্ত করে। জার্মান নৌ আইন অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। ১৯০৬ সালে ব্রিটেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম এবং সর্বাধুনিক ড্রেডনট (যুদ্ধজাহাজ) চালু করে। জবাবে জার্মানিও নিজস্ব ড্রেডনট তৈরি করে। জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যকার এই প্রতিযোগিতা ক্রমশই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জার্মানির ২৯টি অপারেশনাল ইউ-বোট ছিল। জার্মানির নৌশক্তির এমন বৃদ্ধি ব্রিটেনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
জার্মানির এমন স¤প্রসারণে ব্রিটেনের জাতীয়তাবাদী জনগণ ও সংবাদমাধ্যম আতঙ্কিত হয়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এই সময় ব্রিটেনও ২৯টি নতুন যুদ্ধজাহাজ চালু করে। ব্রিটেনে অস্ত্র প্রতিযোগিতা মূলত জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্রিটেনের জনগণ ও সংবাদমাধ্যম সামরিক উন্নয়নের জন্য সরকারের চেয়ে বেশি উৎসাহী ছিল। ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমগুলো দেশের সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের জন্য প্রচার চালাতে থাকে। ব্রিটিশ ‘নেভি লীগ’ ও সংবাদমাধ্যমগুলো আরো বেশি যুদ্ধজাহাজ কমিশন করতে সরকারকে আহ্বান জানায়।
১৯০০ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয় সামরিক ব্যয় আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৭০ সালে ছয়টি ইউরোপীয় গ্রেট পাওয়ারের (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, ইতালি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি) সম্মিলিত সামরিক ব্যয় যত ছিল, পঁয়তাল্লিশ বছর পর ১৯১৪ সালে তা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ১৯০৮ সালে গ্রেট ব্রিটেনের সামরিক ব্যয় ছিল ২৮৬ মিলিয়ন ডলার, ১৯১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭৪ মিলিয়ন ডলারে। একই সময়ে ফ্রান্সের সামরিক ব্যয় ২১৬ মিলিয়ন থেকে ৩৬৪ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের শত্রু জার্মানির সামরিক ব্যয় আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯০৮ সালে যেখানে জার্মানির সামরিক ব্যয় ছিল ২৮৬ মিলিয়ন ডলার, ১৯১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬৩ মিলিয়ন ডলারে।
১৯১০ এর দশকে রাশিয়ার সরকারি ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক সামরিক খাতে ব্যয় করা হয়। ১৯০৮ সালে রাশিয়ান সামরিক ব্যয় ছিল ২৯১ মিলিয়ন ডলার। ১৯১৩ সালে তাদের সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩৫ মিলিয়ন ডলারে। রাশিয়ার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কারণ ছিল রুশো-জাপানিজ যুদ্ধ (১৯০৪-১৯০৫)। রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে চীন-কোরীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও জাপান যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। রাশিয়া এই যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে। এই পরাজয় রাশিয়াকে নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে এবং জোট গঠনে আগ্রহী করে তোলে। এরপর রাশিয়া ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সাথে জোট গঠন করে যা ত্রিশক্তি আঁতাত নামে পরিচিত।
এই ঘটনার সমসাময়িক সময়ে বলকান অঞ্চলের জাতিসমূহ একদিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছিল, অন্যদিকে অটোমান শাসন থেকেও মুক্তি চাচ্ছিল। এই সুযোগে রাশিয়া এই অঞ্চলের স্লাভিক জনগোষ্ঠীকে প্যান-স্লাভ জাতীয়তাবাদ এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত করতে থাকে। রাশিয়া তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অটোমান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যকে বলকান অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে সেই স্থান দখল করতে চাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদের আদর্শে বলীয়ান হয়েই গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ নামক ঊনিশ বছর বয়স্ক এক তরুণ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান যুবরাজকে গুলি করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। প্যান-স্লাভ জাতীয়তাবাদীরা একদিকে অটোমান সাম্রাজ্য অন্যদিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি চাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে পরাশক্তিদের অধীনে থাকা উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা দাবি করে। প্যান-স্লাভিজম হলো এমন একটি ধারণা যারা বিশ্বাস করে যে, পূর্ব ইউরোপের স্লাভিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব স্বাধীন দেশ হওয়া উচিত। ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্যান-স্লাভিজম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। স্লাভিক জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল সার্বিয়ায়।
প্যান-স্লাভিজম জাতীয়তাবাদ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য এবং এই অঞ্চলে এর নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের বিরোধিতা করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য কর্তৃক বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনা সংযুক্তিকরণের ফলে উত্তেজিত হয়ে অনেক তরুণ সার্ব ‘ব্ল্যাক হ্যান্ড’-এর মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দেয়। এই গোষ্ঠীগুলো বলকান অঞ্চল থেকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিদায় এবং সমস্ত স্লাভিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি একীভূত ‘গ্রেটার সার্বিয়া’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করছিল। এই প্যান-স্লাভিক জাতীয়তাবাদই ১৯১৪ সালের জুনে সারায়েভোতে ‘আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ড’কে হত্যার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। এজন্য জাতীয়তাবাদকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯১৪ সালের জুনে অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী ‘আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ তাঁর স্ত্রী সোফি’কে নিয়ে বসনিয়া সফরে যান। বসনিয়া ছিল তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের দখলে। বসনিয়া তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বসনিয়ার কৃষকেরা তখন নিদারুণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন, দিনের পর দিন শোষণের ভারে তাঁরা ছিলেন একেবারে পর্যুদস্ত। এসব ভয়ংকর দিন পরিবর্তনের জন্য কেউ যখন কিছু করছিল না, তখন দেশটির একদল তরুণ নিজেরাই কিছু একটা করতে উদ্যোগী হন। ‘প্রিন্সিপ’ ছিলেন এই ‘বিপ্লবী’ দলের একজন। ‘আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ’ তাঁর স্ত্রী ‘সোফি’ ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে অবস্থানরত অনুগত সেনাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। গন্তব্যস্থলে যাওয়ার পথেই সার্বিয়ান সন্ত্রাসীদের ছোড়া হাতবোমা থেকে তাঁরা অল্পের জন্য বেঁচে যান। এই যাত্রায় বেঁচে গেলেও দিনের আরও পরের দিকে আরেকটি হামলায় ভাগ্য তাঁদের সহায় হয়নি। সার্বিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপে’র ছোড়া বুলেটে মারা যান ‘ফার্দিনান্দ ও সোফি’। প্রিন্সিপ ছিলেন সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য। উগ্র প্রিন্সিপের বয়স তখন মাত্র ১৯ এবং তিনি ছিলেন এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান। ইউরোপে তখন আততায়ীদের হাতে এমন প্রাণনাশের ঘটনা বিরল না হলেও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য এ খুনের ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় এবং জার্মানির সহায়তায় এক মাসের মাথায় ২৮ জুলাই তারা সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সূত্রপাত ঘটে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের।
মোট কথা, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর সে বছরের আগস্ট মাসে ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানি। দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গ্রেট ব্রিটেনও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সে সময়ের সব কটি প্রভাবশালী দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। অক্টোবর মাসে যখন প্রিন্সিপের বিচার শুরু হলো, ততক্ষণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামরিক দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদের বিকাশ, একই সঙ্গে উসমানি সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা, অমীমাংসিত ভূখণ্ডগত বিরোধসহ আরো যত কারণ বিদ্যমান থাকুক না কেন এই সমস্যগুলো উসকে দিতে এই আগুনে ঘি ঢেলেছিল ১৯ বছর বয়সি সার্বিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপের ছোড়া বুলেট। যে বুলেটে নিহত হন অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফি। বিশ্লেষকগণ মনে করেণ যুবরাজ ও তার স্ত্রীর মৃত্যুই প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে উসকে দেয়ার প্রধানতম কারণ।
লেখক : কলামিস্ট
Email: khobir72@gmail.com