বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রশ্নকরা নিয়ে যে, খুব একটা মাথা ঘামান না সেটি শক্তভাবে প্রমাণিত হলো। এই প্রশ্ন একাধিক প্রশ্নকর্তার মধ্যে থেকে বাছাই করা হয়। তারপর, এটি মডারেট করতে হয়। কারুর চোখেই ধরা পড়েনি এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়টি। শিক্ষার অনেক ক্ষেত্রেই যে, উদাসীনতা চলছে সেটি মুখে না শুনে কাজেই প্রমাণিত হচ্ছে বার বার।
মাছুম বিল্লাহ
৬ নভেম্বর ২০২২ থেকে দেশে শুরু হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ঢাকা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে প্রণীত প্রশ্নপত্র ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে ক্ষুন্ন করেছে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন এটি রীতিমতো ধর্মীয় উসকানির শামিল। ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র সৃজনশীল ১১নম্বর প্রশ্নে নাটক সিরাজউদ্দৌলা অংশের অনুচ্ছেদে ধর্মকে সামনাসামনি করে উদ্দীপকে কয়েকটি সংবেদনশীল কথা বলা হয়েছে। উদ্দীপকটি হচ্ছে-নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বন্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।
প্রশ্নগুলো হচ্ছে—(ক) মিরজাফর কোন দেশ হতে ভারতে আসেন। (খ) “ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব।”-ব্যাখ্যা কর। (গ) উদ্দীপকের ’নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে ‘সিরাজউদ্দৌলা নাটকে ’মিরজাফর চরিত্রের তুলনা কর। (ঘ) ‘খাল কেটে কুমীর আনা’। প্রবাদটি উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।-উক্তিটির সার্থকতা নিরূপন কর।
এখানে কয়েকটি বিষয় চলে এসেছে-
এক. ধর্মীয় বা যে কোন সংবেদনশীল বিষয় জাতীয় পরীক্ষা কেন কোন ধরনের পরীক্ষায়ই দেওয়া যাবেনা সেটি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।
দুই. বোর্ডের প্রশ্ন যারা করেন তারা কোন মানের সেটিও সামনে এলো। সবাই কি বোর্ডের প্রশ্ন করতে পারেন? প্রশ্ন করার দায়িত্ব কারা পাচ্ছেন?
তিন. দেশে সৃজনশীল প্রশ্নের এই দশা!সৃজনশীল প্রশ্ন শুরু হয়েছে একযুগের বেশি সময় হয়েছে অথচ এখনও এই অবস্থা!
চার. এটি কিন্তু প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিকের প্রশ্ন নয়, উচচ মাধ্যমিকের প্রশ্ন।
নিশ্চয়ই কোন কলেজ টিচার এই প্রশ্ন করেছেন। খোদ ঢাকা বোর্ডের প্রশ্ন। যে শিক্ষকই করুন না কেন প্রশ্ন করা সম্পর্কে যে তার কোনও ধারনা নেই সেটি প্রমাণিত হলো। এক বোর্ডের প্রশ্ন অন্য বোর্ডের শিক্ষকরা করেন। দেশের যে প্রান্ত থেকেই করুক না কেন প্রশ্নকর্তার যে প্রশ্ন করা সম্পর্কে ধারনা নেই সেটি স্পষ্ট হলো এবং বুঝা গেল যে, বোর্ড এ ধরনের অনেকের দ্বারাই প্রশ্ন করিয়ে থাকেন যারা প্রশ্ন করার উপযুক্ত নয়। সবশেষ যেটি বলতে চাই সেটি হচ্ছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রশ্নকরা নিয়ে যে, খুব একটা মাথা ঘামান না সেটি শক্তভাবে প্রমাণিত হলো। এই প্রশ্ন একাধিক প্রশ্নকর্তার মধ্যে থেকে বাছাই করা হয়। তারপর, এটি মডারেট করতে হয়। কারুর চোখেই ধরা পড়েনি এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়টি। শিক্ষার অনেক ক্ষেত্রেই যে, উদাসীনতা চলছে সেটি মুখে না শুনে কাজেই প্রমাণিত হচ্ছে বার বার। এ শিক্ষক কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেননি কারন এ ধরনের প্রশ্ন যে, তার জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে সে সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ। আসলে তিনি কখনোই বোর্ডের প্রশ্ন করেন নি। তাকে কেন দেওয়া হলো এই দায়িত্ব?
বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রশ্নকরা বা প্রশ্নের মান নিয়ে যে কতটা ভাবেন তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কয়েকবছর আগে এনসিটিবিতে বিভিন্ন কারণে ডাক পেতাম । হয়তো ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলাম ও শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করি সেই সুবাদে। সেখানে প্রশ্ন করা নিয়েই একটি সেমিনার ছিল। দেশের সব বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকগন ছিলেন। আমি একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম যে, আমি ক্যাডেট কলেজের পর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে থাকাকালীন ইংরেজির প্রশ্নে একটি প্যাসেজ বানিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানে প্রশ্ন ছাপতে গিয়ে একটি শব্দ ভুল ছাপা হয়েছিল যা আভ্যন্তরীন পরীক্ষায় আমরা সঠিক করে দিয়েছি। কিন্তু রাজউক কলেজের প্রশ্ন বিধায় সাথে সাথে সেই প্রশ্ন ভুলসহ সব টেস্ট পেপারে ছাপা হয়েছে। রাজউক কলেজের চাকরি ছেড়ে আমি তখন ব্র্যাক প্রধান কার্যালয়ে কাজ করি ইতিমধ্যে আট বছর হয়ে গেছে। তখনও দেখতে পাচ্ছিলাম যে, দেশের বিভিন্ন কলেজ সেই প্রশ্নটি একটি শব্দ ভুলসহ আট বছর পর্যন্ত তাদের টেষ্ট পরীক্ষাগুলোতে দিয়ে আসছে। তার অর্থ হচ্ছে শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্ন তৈরি করেন না ব্যতিক্রম ছাড়া। একটি ভুল যে আছে সেটিও আট বছরে কারুর চোখে ধরা পড়েনি। দ্বিতীয় পয়েন্ট ছিল ইংরেজি টেস্কটবইয়ে আশি থেকে একশত কিংবা তারও বেশি লেসন থাকে। সেখান থেকে মাত্র ৫ থেকে ৬ লেসন শিক্ষার্থীরা পড়ে, শিক্ষকরাও পড়িয়ে থাকেন, এর বাইরে যান না। যারা আরও নামকরা শিক্ষক(?) অর্থাৎ যাদের প্রাইভেটের খুব নামডাক তারা আরও কম লেসন পড়িয়ে থাকেন।কারণ দুই থেকে তিনটি প্যাসেজ পড়িয়ে পরীক্ষায় কমন ফেলতে পারলে তাদের শিক্ষার্থীর অভাব হয়না। একই প্রশ্ন সব বোর্ডে ঘুরে ঘুরে আসছে। ৫/৬টি লেসনের বাইরে আর কেউ যায়না। তাহলে শিক্ষার্থীরাই বা কি শিখবে আর শিক্ষকই বা কি পড়ান?
আমি প্রস্তাব করলাম যে, মাননীয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকগণ বিষয়টি দেখলে ভাল হয় যাতে এ ধরনের ট্রাডিশন বন্ধ হয়। তা না হলে শিক্ষার্থীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। উত্তরে কয়েকজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সুন্দর করে বলেছিলেন’ বোর্ডের প্রশ্নও করেন শিক্ষকরা, প্রশ্ন মডারেটও করেন তারা। সেখানে কি থাকে বা না থাকে তা দেখার বিষয় আমাদের নয়।’ আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম- একজন কন্ট্রোলার নিজেকে শিক্ষক পরিচয় দিতে হয়তো ইতস্তত করছেন। আর বোর্ডের প্রশ্নে কি করা হয় বা না হয় সেটি দেখার তাদের সময় নেই। আমি বলেছিলাম এটি বলে দায়িত্ব এড়ানো যাবেনা। আপনারা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, পরীক্ষার যে কোন বিষয় আপনাদের পুঙ্খানুপুঙখরূপে দেখতে হবে, জানতে হবে।’ যাই হোক তার পর থেকে কোনদিন আর এনসিটিবিতে দাওয়াত পাইনি।
ঢাকাবোর্ডের এই প্রশ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদগন মন্তব্য করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, দেশে ধর্র্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও প্রশ্নপত্রে ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের বাস্তবিক চিত্রও এমন নয়। ধর্মীয় নানা উৎসবে দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সবাই অংশগ্রহন করে। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন কাঠামো কেমন হবে- এ ধরনের লিখিত নির্দেশনা এবং প্রশ্নপ্রণেতা ও প্রশ্ন সেটারদের ওরিয়েন্টেশন করানো হয়। এর পরেও অমূলক প্রসঙ্গ টেনে ধর্মীয় উসকানি দেওয়া হয়েছে। এতে করে সমাজে বিদ্বেষ ছড়াতে পারে।
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ধর্মকে সামনাসামনি করা ঠিক হয়নি। মুসলমানের কাছে জমি বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করছে —সমস্ত তথ্য সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্খিত ঘটনা কখনো কাম্য নয়।আরও ভাল প্রশ্ন করা যেতো। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতাবোধ বাড়ানো। ধর্মে ধর্মে সহিষ্ণুতা বাড়াতে কাজ করা। অনেক চিন্তা করে পরীক্ষার প্রশ্ন করা প্রয়োজন বলে অধ্যাপক কায়কোবাদ মনে করেন।
আন্ত:শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচচ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন,‘ সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ন কোন বক্তব্য যেন না থাকে সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা নিয়ে ওরিয়েন্টেশন করানো হয়। প্রশ্নপ্রত্র দেখার কোন সুযোগ নেই। কীভাবে এ ধরনের প্রশ্ন করা হলো তা পর্যালোচন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।’
এ প্রসঙ্গে আমার আর একটি ঘটনা মনে পড়েছে। আমি ঘাটইল ক্যান্টমেন্ট কলেজে শিক্ষক থাকাকালীন (১৯৯১-১৯৯২) ভারতে রামমন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তখন ক্লাসের কিছু শিক্ষাথী হিন্দু শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলো ’ স্যার ওরা আমাদের মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছে, এখন আমরা ওদের মাইর শুরু করি?” আমি বলেছিলাম, কেন? ওরা কি করেছে? বললো যে, ওদের লোকজনই তো আমাদের বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছে। সেদিন এই বিষয়টি নিয়েই ক্লাস করেছিলাম। প্রথম বললাম, ওরা তো মসজিদ ভাঙ্গেনি। ওদের কি দোষ? ওদের কয়েকজনের জায়গায় তোমরা বৃহত্তর অংশ নিজেদের কল্পনা কর, তোমাদের ক্লাসমেটরা কলেজে পড়ে যদি তোমাদের নিয়ে এ ধরনের কথা বলতো তখন তোমাদের কেমন লাগত? ওদের ভেতর আর তোমাদের ভেতর তফাৎ কি? ওদের মধ্যে যেসব চাহিদা আছে, তোমাদেরও আছে। পার্থক্য কোথায়? ওরা ওদের পরিবারে জন্মনিয়ে দেখেছে কালচারাল কিছু বিষয় । সেগুলোর সাথে ওদের পরিচিতি ও ভালবাসার সম্পর্ক হয়ে যায় যেমনটি তোমাদের পরিবারের কালচারেও ঘটেছে। তাহলে ওরা কিভাবে তোমাদের বিরোধী? কিছু উগ্র ধর্মবাদীরা এ কাজ করে থাকে। তোমরা শিক্ষাগ্রহন করছে মানুষের মতো মানুষ হতে, সহমর্মিতা শিখতে তা না হলে তো কলেজে আসার দরকার ছিলনা। তুমি আমি যদি তোমার পরিবারে জন্ম না নিয়ে এমন একটি পরিবারে জন্ম নিতে যেখানকার অভিভাবকগণ রবিবার চার্চে যাচ্ছেন, তখন তুমি আমি তো তাই শিখতাম, তাই করতাম। এজন্য কি তুমি বা আমি দায়ী? কাজেই এগুলো নিয়ে বিভেদ ও ভাঙন সৃষ্টি যাতে না হয় শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে এটিও একটি বড় উদ্দেশ্য। আশা করি অনেকে শিক্ষার্থীরা সেদিন কিছুটা হলেও বিষয়টি বুঝেছিল। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হবে মানুষকে ভালবাসা, তার ধর্ম বর্ণ বা ভাষা দেখে বিভেদ সৃষ্টি করা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকসহ সবাইকে প্রকৃত মানবতার চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাবেক ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক
ইমেইল:masumbillah65@gmail.com