মো. সাখাওয়াত হোসেন
সমসাময়িক সময়ে রাজনৈতিক দলের সমাবেশে কিংবা মিটিং মিছিলে একটি বড় অংশ শিশু কিশোরদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। যে কোন রাজনৈতিক দলের সমাবেশে এমনটি দেখা যায় এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলের নজর কেড়েছে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে। মাঝে মধ্যে গণমাধ্যমের বরাতে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে অর্থের লেনদেনের ছড়াছড়ি, লেনদেনের বিষয়টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার প্রার্থিদের ভোটারদের নিকট হতে ভোট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে টাকার বিনিময় রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কলুষিত করার নামান্তর। কাজেই রাজনৈতিক দলের সমাবেশে জনসমাগম দেখে রাজনৈতিক দলের সমর্থন কিংবা রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিশাল সংখ্যক উপস্থিতি বিদ্যমান এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাছাড়া ভোটের মাঠে শেষ বলে কিছু নেই, বাঙালি ভোটাররা ভোট প্রদানের পূর্বে সার্বিক বিষয়াদি যাচাই বাছাই করেই ভোট প্রদান করে থাকে।
বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে থাকে একটি সুনির্দিষ্ট পক্ষ। এ বিরোধিতা সকল পর্যায়ে সবক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আপনি যত ভাল কাজই করুন না কেন, কোন না কোন ছুতোয় সেটির বিরোধিতা তারা করবেই। বাংলাদেশে একটি সুনির্দিষ্ট পত্রিকার মালিক পক্ষ রয়েছে যারা মুখরোচক অনেক সংবাদ প্রকাশ করে বিরোধীদের কৃপা পাওয়ার চেষ্টা করে। মুখরোচক বলতে বিষয়টি এমন বোঝায়, সংবাদের কোনরূপ যাচাই বাছাই ব্যতিরেকে সংবাদ পরিবেশন করা একধরনের মুখরোচক খবর এবং এতে সত্যের চেয়ে মিথ্যার প্রচার প্রচারণা বেশি থাকে।
কিছুদিন পূর্বে ১/১১ এর সময়ে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত বেশ কিছু সংবাদের জন্য পত্রিকাটির প্রকাশক একটি টিভি অনুষ্ঠানে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ভবিষ্যতে সংবাদ পরিবেশনের পূর্বে আরও সতর্ক হওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। দেশ পরিচালনা করা সহজ কাজ নয়, পরিচালনা করতে গিয়ে ভুল ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বেশ ক’টি গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগ পরিচালিত সরকারের কৃতিত্ব নিয়ে তেমন কোন সংবাদ পরিবেশন হয় না, হলেও সেটি তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয় না, অথচ বিগত বছরগুলোতে কৃতিত্ব পাওয়ার মতো বহু অর্জন আওয়ামী লীগ সরকারের রয়েছে। অন্যদিকে সন্দেহের বশবর্তী কোন সংবাদ পেলে সেটি খুব ফলাও করে পরিবেশনের রীতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
আমরা যদি পদ্মা সেতুর বিষয়ে উল্লেখ করি তাহলে দেখা যাবে বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে সকল খবর খুব ফলাও করে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ পত্রিকাগুলোর ভাষ্য এমন ছিল তারাও চাচ্ছে না, পদ্মা সেতুটি আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেই হউক। তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন মিডিয়ার উপর্যুপরি আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একটি বিশেষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রশংসা করেছে। পরবর্তীতে সব জল ঘোলা করে কানাডার আদালত যখন ঘোষণা দিল পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক কোন অর্থ ছাড়েনি সেহেতু পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কোন সুযোগ নেই। এর পরে কিন্তু বাংলাদেশী কতিপয় মিডিয়ার মুখোশ উন্মোচিত হয় সাধারণ জনগণের কাছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে মর্মে খবর যে গুরুত্ব দিয়ে পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে পরবর্তীতে পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কার্পাণ্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এতেই কিন্তু তাদের মুখোশ উন্মেচিত হয়েছে। অর্থাৎ সত্যের জয় উন্মোচিত হয়েছে, সত্য কিছুটা দেরিতে হয়ত প্রকাশিত হয় তথাপি সত্য আবিস্কৃত হবেই।
বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, দলটি বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দলটি সরকারের বিপরীতে জনগণের সমর্থন নিয়ে কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এদিকে দলীয় কার্যাক্রমের অংশ হিসেবে বিএনপি দেশব্যাপী রাজনৈতিক সমাবেশ আহবান করেছে এবং সমাবেশের উপস্থিতিকে তারা তাদের রাজনৈতিক জনসমর্থনের অংশীদার হিসেবে দাবি করেছে। কার্যত, বিএনপির সমাবেশে যারা অংশগ্রহণ করে সবাই কি দলটির সমর্থনে রাজনৈতিক সমাবেশে যোগদান করে? এ ব্যাপারে একটি উদাহরণ সকলের বুঝবার জন্য সহায়ক হতে পারে।
সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়, কুমিল্লায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশস্থল থেকে মোবাইল চুরির হিড়িক পড়েছে। সমাবেশে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানার মোবাইল ফোন চুরি হয়। শুধু তাই নয়, সমাবেশস্থল থেকে আরও অর্ধশতাধিক মোবাইল চুরির তথ্য মিলেছে। ব্যরিষ্টার রুমিন ফারহানা নিজেই গণমাধ্যমকে তার মোবাইল চুরির তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, শুক্রবার রাতে টাউনহল মাঠে জনস্রোত দেখতে আসি। এরপরই আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে যায়। এদিকে আরও জানা যায়, শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর ফোন চুরি হয়েছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে কুমিল্লাসহ দেশব্যাপী বিএনপির জনসমাবেশে যে জনস্রোতের বিষয়ে বিএনপির নেতারা উচ্চবাচ্য করে তারা সকলেই যে দলের শুভাকাঙ্খী নয় সেটি কিন্তু স্পষ্ট। কুমিল্লার সমাবেশের মোবাইল চোর নিশ্চয়ই দলটিকে সমর্থন করে থাকলে দলের নেতাদের মোবাইল চুরি করতে পারত না।
বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ, কেন্দ্র ঘোষিত কমিটিকে উপেক্ষা করে স্থানীয়ভাবে পাল্টা কমিটি গঠন, বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের দলত্যাগের কারণে, অনেক পোড় খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কোন কারণ ছাড়াই দল থেকে বহিষ্কারের কারণে দলটি কার্যাত সংকটকাল পার করছে। এ সংকটকাল অতিক্রম করতে বিএনপি দেশব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এবং তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা অনেকাংশে উজ্জীবিত হয়ে অংশগ্রহণ করছে। একটা বিষয় ভেবে দেখেন, বিভাগীয় সমাবেশ সেখানে বিভাগের অন্তর্ভুক্ত সকল জেলা উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগীরা উপস্থিত হলেও একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জনসাধারণের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। কাজেই এ ধরনের সমাবেশ জনসমর্থন নির্দেশ করে, এমনটা রাজনৈতিক বোদ্ধারা হয়তো ভাববেন না। তাছাড়া আওয়ামী বিরোধী একটি শক্তি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয় এবং একটু বিশ্লেষণ করে দেখবেন একশ্রেণির নেতৃত্ব রয়েছে যারা বিএনপির প্রত্যেকটি সমাবেশে অংশ নিয়ে লোকবল বাড়ানোর কাজটি হাতে নিয়েছে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ কার্যতভাবে বিএনপির জনসমর্থন বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বিএনপির দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, এতদিনেও তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কোনরূপ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। যদি জনসমর্থন থাকতোই তাহলে তারা কিন্তু তাদের দলীয় প্রধানের মুক্তির বিষয়েও আন্দোলন গড়ে তুলতেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে আওয়ামী বিরোধী একটি বলয় তৈরি হয়েছে। সুযোগ পেলেই তারা আওয়ামী বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। এ বিরোধী পক্ষটিও সরকার পতনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির গতি প্রকৃতি ও আন্দোলনকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিএনপির সমাবেশে অংশ নিয়ে থাকে। এ অংশটি কি বিএনপি সমর্থনে জনসমাবেশে অংশ করে? নিশ্চিত করে বলা যায়, তারা বিএনপির সমর্থনে অংশগ্রহণ করে না, তারা সরকারের বিরোধী হিসেবে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে থাকে। কাজেই এ পক্ষের মানুষের জনসমাবেশে অংশগ্রহণ বিএনপির জনসমর্থনকে নির্দেশ করে না। আবার একটি পক্ষ রয়েছে যারা সরকারের বিপরীত অংশের রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা শোনার উদ্দেশ্যে জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করে থাকে। আদৌ কি এ অংশটি সরকারের বিরুদ্ধে জনস্রোত তৈরি করতে পারবে, আওয়ামী লীগকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে ইত্যাদি বিষয় পর্যাবেক্ষণের জন্য সমাবেশে অংশ নিয়ে থাকে। এ বিষয়গুলো কি নৈতিকভাবে বিএনপির সমর্থনের অংশ? সাধারণত সব সময় সাধারণ মানুষ বিরোধী দলের বক্তব্য কি শুনতে চায়, বক্তব্য শুনে ভোট প্রদানের সময় যাচাই বাছাই করে ভোট প্রদান করে থাকে। এ বিশেষ অংশটিও জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ অংশটি কি বিএনপির সমর্থনে জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করে? মোটামুটিভাবে বলা যায়, বিএনপির অবস্থান বুঝতে, আন্দোলনের গতি প্রকৃতি বুঝতে এ পক্ষটি সমাবেশে অংশ নিয়ে থাকে, কোনভাবেই বিএনপির সমর্থনে নয়।
বিএনপির জনসমাবেশের একটি অংশে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিশোর যোগদান করে, এদেরকে সমাবেশের নামে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মিছিল ও সমাবেশে নিয়ে আনা হয়। ঢাকা শহরসহ সারাদেশে একটি চক্র রয়েছে যারা মিটিং মিছিল সমাবেশে শিশু কিশোরদের টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করে থাকে। এজন্য দলগুলোকে বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়, বিএনপি যে এ চক্রের সহায়তা গ্রহণ করেনি সেটিও আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। কেননা, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা রাজনীতি কোনকিছু না বুঝেই সামান্য টাকার বদৌলতে সমাবেশে অংশ নিয়ে থাকে। কাজেই বিএনপির জনসমাবেশে উল্লেখ্যযোগ্য জনতার উপস্থিতি কোনভাবেই দলটির জনসমর্থন নির্দেশ করে না।
লেখক:সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।