মানুষ জয়ীদের মনে রাখে, পরাজিতদের নয়

কোয়ার্টার ফাইনালে একের পর এক ঘটনাবহুল রাত আসবে কে জানতো? মেসির ঐশ্বরিক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছালেও, ব্যর্থ হয়েছে টাইব্রেকারে হেরে যাওয়া নেইমারের ব্রাজিল। পরপর দু’বারের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব থেকে বাদ পড়ল সেলেসাওরা। অন্যদিকে, আট বছরের ব্যবধানে আবারও সেমিফাইনালে আলবিসেলেস্তেরা। এই দুই দলের সমর্থনে দুভাগে বিভক্ত বাংলাদেশিদের মনে একদিকে আনন্দের বন্যা অন্যদিকে হতাশা। পর্তুগালকে ১-০ গোলে হারিয়ে মরক্কো গড়েছে ইতিহাস। এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটিয়েছে তারা। প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে মরক্কো এবার খেলবে সেমিফাইনাল। অন্য কোয়ার্টারে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের জমজমাট ম্যাচে ফ্রান্সের জিরুদ ২-১ গোলের জয় ছিনিয়ে এনেছেন লা ব্লুজদের জন্য। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মন্টিয়েল এবং অ্যাকুনাকে ছাড়াই নামতে হচ্ছে আর্জেন্টিনাকে। তবে আর্জেন্টিনা কখনোই সেমিফাইনাল হারেনি। এর আগে তারা চারবার সেমিফাইনাল খেলেছে। চিন্তার বিষয়টি হল শুক্রবার রাতে আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস খেলায় ম্যাচ পরিচালনাকারী স্প্যানিশ রেফারি আন্তোনিও লাহোজের বাজে রেফারিং-এর কল্যাণে ১৭টি হলুদ কার্ড দেখে দুই দল। যা মাঠে খেলোয়াড়দের বেশ উত্তপ্ত করে দেয়।

বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে খেলা চলাকালীন। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আর্জেন্টিনা এবং নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে ফিফা। ওই ম্যাচে বেশ কিছু হলুদ কার্ড পায় আর্জেন্টিনা, যে তালিকায় মেসি নিজেও আছেন। আছেন, আর্জেন্টিনার হেড কোচ স্কালোনিও। আর্জেন্টিনার দুজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ওই কার্ডের জেরে সেমিফাইনালে খেলতে পারবেন না।

সেমিফাইনালে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পদ্ধতিতে খেলবে আর্জেন্টিনা। বেশি তাড়া করে ফুটবল খেলতে যেয়ে আরও বেশি কার্ডে নাম জড়াতে চাইবে না।

কোয়ার্টার ফাইনালের হট-ফেভারিট ব্রাজিল ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের শুরু থেকে কৌশলগত যে ভুল করে একটু গুছিয়ে পেছন দিক থেকে বিল্ড আপ শুরু করেছিল, তার পুরো খেসারত দিতে হয়েছে তাদের। পুরো ম্যাচে ব্রাজিলের কাছে পাওয়ার মতো যা ছিল তা হল নেইমারের দৃষ্টিনন্দন গোল, অ্যান্টনির দারুণ উইং অ্যাটাক আর থিয়াগো সিলভার নির্ভুল ফুটবল। এছাড়া, পুরো খেলাটিই ছিল ক্রোয়েশিয়াময়।

ব্রাজিলের গোল হাতছাড়া করা মিসগুলো মনে থাকবে। তবে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। পরপর দুবারের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। সামনের বিশ্বকাপ আসরে নেইমার খেলবেন কি না তা তিনি নিজেও জানেন না। আর খেললেও ফিটনেস কেমন থাকবে বা তার খেলার পজিশন কী থাকবে, তা নিয়ে বহু আলোচনা হবে।

আর্জেন্টিনা যে ক্রোয়েশিয়ার সাথে ব্রাজিলের কৌশলে খেলবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এটি ঠিক ক্রোয়েশিয়া ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ব্রাজিলকে হারিয়েছে। তবে, ওই ম্যাচে ব্রাজিলের খারাপ পরিকল্পনা এবং বাজে ফুটবল ছিল চোখে পড়ার মতো যা ক্রোয়েশিয়ার জয়কে অনেকটাই সহজ করে দেয়। টিটে যাদের বদলি খেলোয়াড় হিসেবে (যার সবটাই ভুল সময়ে নেয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল) মাঠে নামিয়েছেন, তাদের কেউই কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি, একমাত্র অ্যান্টনি ছাড়া।

সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হল, মার্তিনেল্লির মতো একজন খেলোয়াড়কে বসিয়ে রেখে টিটে কী অর্জন করতে চেয়েছেন তা সম্ভবত কারো বোধগম্য নয়। আর এক গোলে এগিয়ে থাকার পরও ব্রাজিল কেনই-বা এতো আক্রমণে গেল এবং সবশেষে মার্কুইনহোসের ভুলে গোলটি হজম করে টাইব্রেকারে গিয়ে হারল সেটিও স্পষ্ট নয়। কেন নেইমার আসলেন না পেনাল্টি নিতে, সেটি নিয়েও কম আলোচনা হচ্ছে না।

নেইমারের কান্না পৃথিবীর জন্য কষ্টের কিন্তু ব্রাজিলের জন্য এই হার ব্রাজিলসহ সারা বিশ্বের ব্রাজিল সমর্থকদের জন্য আরও বেশি দুঃখজনক। তারা ব্রাজিলের হারটিকে মনে রাখবে, নেইমারের কান্নাকে নয়। এমন একটি দল ব্রাজিল আবার কবে পাবে? টিটে ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। সেলেসাওদের নতুন কোচ কে হবেন সেটিও বলা যাচ্ছে না। সময়ই বলে দেবে কী হবে ব্রাজিলের ভাগ্যে।

আর্জেন্টিনা দুই গোলে এগিয়ে গিয়েও যে দুটি গোল খেয়ে বসেছে নেদারল্যান্ডসের কাছে এ বিষয়টি যেকোনো পরিস্থিতিতেই মেনে নেয়া যায় না। বিশেষ করে স্কালোনি যখন রোমেরো এবং আলভারেজকে তুলে নিলেন মাঠ থেকে, তখন একটু বেশি আস্থাবান মনে হচ্ছিল তার ওই সিদ্ধান্তকে। যাই হোক নার্ভের আর কুৎসিত মারামারির খেলায় আর্জেন্টিনার জয় হয়েছে। এমি মার্টিনেজ স্পট কিক ঠেকানোর মাস্টার তা আবার প্রমাণ করেছেন। মেসি এবং আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা দিবু’র (এমি মার্টিনেজ) উপর বাড়তি আস্থা রাখে এটি সবার জানা, আর তাই মেসির জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত এমি মার্টিনেজ আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে ঠিক-ঠিক পৌঁছে দিয়েছেন।

রোনালদো আর নেইমারের দুঃখভারাক্রান্ত বিদায় সারা বিশ্বের দর্শকদের কাঁদিয়েছে, অনেকেই ঘোর বিষণ্ণতায় গেছেন এবং এটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ খেলাটির নাম ফুটবল, তা-ও বিশ্বকাপের মতো আসর। অন্তত এরকম মানের খেলোয়াড়দের কোয়ার্টার পর্ব থেকেই চলে যেতে হবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচে প্রথমার্ধে রোনালদোকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখার জন্য চলছে তুমুল সমালোচনা। চলবে বহুদিন। আর একটু আগেই বলেছি নেইমার কেন চতুর্থ পেনাল্টি নিলেন না টাইব্রেকারে, তা নিয়েও আলোচনা সহসাই শেষ হওয়ার নয়। দিনশেষে মানুষ জয়ীদের মনে রাখে। পরাজিতদের নয়।

সাদা চোখে দেখলে আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের ফাইনাল দেখতে পারছি। আর্জেন্টিনার সামনে দুটি প্রতিশোধের সুযোগ থাকছে যদি তারা ক্রোয়েশিয়াকে হারাতে পারে এবং ফাইনালে ফ্রান্সকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায়। গত বিশ্বকাপে গ্রুপ স্টেজে ক্রোয়েশিয়ার কাছে এবং রাউন্ড অব সিক্সটিনে ফ্রান্সের কাছে হারের প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে আর্জেন্টিনার জন্য। এখন বাকি হিসেব মিললেই হয়।

ফুটবলের জন্য, ফুটবল যার জন্য, ফুটবল বিশ্ব যার কাছে চিরঋণী, সেই লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ যাবে এমনটাই চাইছে বিশ্বের বেশিরভাগ ফুটবলপ্রেমীরা। সঠিক পরিশ্রম আর ভাগ্য ঠিক করে দেবে কার হাতে উঠবে কাতার বিশ্বকাপের মহামূল্যবান শিরোপা। আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া-ফ্রান্স-মরক্কো, প্রতিটি দলের জন্যই নিরন্তর শুভ কামনা রইল।

লেখক: চ্যানেল আই অনলাইনের ডিজিটাল অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া এডিটর এবং চ্যানেল আইয়ের নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের (এনসিএ) সহকারী মহাব্যবস্থাপক।

Print Friendly

Related Posts