শাহ মতিন টিপু
বিজয় মানে পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনভাবে চলা। বিজয় মানে একটি দেশ, একটি লাল সবুজ পতাকার অধিকার পাওয়া।বিজয় মানে পরাধীনতা থেকে মুক্তি, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্যরকম এক শক্তি। বিজয় মানে মাথা উঁচু করে রেখে বাঁচা। বিজয় মানে বুক ভরে নেওয়া প্রশান্তির নিঃশ্বাস, আমার অধিকার থাকবে শুধু আমারই-এমনই দৃঢ় বিশ্বাস। বিজয় মানে নতুন দেশ স্বপ্নের বাংলাদেশ, বিজয় মানে শপথ গ্রহণ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ।
প্রায় দিশেহারা একটি জাতির সামনে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব ছিল আলোকবর্তিকার মতো। যখন পরাধীনতা ও দাসত্বের শেকলে আটকা পড়েছিল দেশ, এমন এক দুঃসময়ে সাহস এবং অপরাজেয় সংকল্পের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন অসাধারণ দৃঢ় চরিত্রের নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। তিনি তার পুরো জীবন ব্যয় করেছিলেন ঘুমন্ত জাতির জাগরণের পেছনে। আত্মশক্তিতে শক্তিশালী করে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার দিকে। তিনি জাতিকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন।
দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ প্রিয়জনের জীবনের বিনিময়ে আমাদের বিজয়ের দিনটি আসে। বুক ভরা বেদনা আর অশ্রæ বিসর্জনে পাওয়া এ বিজয় আমাদের কাছে সবচেয়ে গৌরবের। বিজয় মানে দেশপ্রেম দেশ বাঁচাতে লড়াই, বিজয় মানে স্বাধীন দেশ বিজয়ের গান গাই। বিজয় মানে স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখা, যে স্বাধীনতার জন্য লড়ে আমরা বিজয় লাভ করেছি সে বিজয়কে সোচ্চার হয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে আঁকা হয়েছে গৌরবের অমলিন এক তিলক। কাক্সিক্ষত এ দিনটির জন্য বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক কাল, পেরোতে হয়েছে পরাধীনতার দীর্ঘ অর্গল। সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের বয়স পাঁচ দশক পূর্ণ হয়েছে। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে এ খুব দীর্ঘ সময় নয়। এককালের পশ্চিম পাকিস্তান এখন নিজেকে পুরো পাকিস্তান বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধের মতো জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যেখানে আমাদের নিজের মতো করে পথচলার সূচনা।
গাঙ্গেয় বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন এখন অনেক। হয়তো এ অর্জনের জন্য আমরা জাতির জনকের কন্যার কাছেই ঋনী। দিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। বাংলাদেশের বিশাল কর্মযজ্ঞের নানা দিকের স্বীকৃতিও বিশ্বের মানুষ দিচ্ছে। দারিদ্র্য কমেছে। অনেক অর্জন এ দেশের মানুষের গৌরবকে হিমালয়তুল্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমাদের প্রথম সংবিধান পৃথিবীর যেকোনো উন্নত রাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে। কিন্তু অশুভ শক্তির হাতে সংবিধানের বহু কাটাছেঁড়া হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মূল স্তম্ভগুলোর অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা, তথা অসাম্প্রদায়িকতা বর্তমান সময়েও বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে অশুভ শক্তির উৎসকে সমূলে উচ্ছেদ করতেই হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করতেই হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই বাংলাদেশ বহু মানুষের রক্তে কেনা। কেবল মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে এ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। তা-ও সমগ্র পৃথিবীর সামনে এক অনন্যসাধারণ অর্জন। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায়, আমরা সে রাষ্ট্রেরই গৌরবময় পতাকাবাহী। পলিমাটিময় এই দেশের মাটি অকল্পনীয়ভাবে উর্বর। এ দেশের প্রকৃতি স্নিগ্ধ, নয়নাভিরাম। মানবসম্পদও আমাদের বড় সম্পদ। সব মিলিয়ে শত সম্পদে ভরা বাংলাদেশ বিপুল বৈচিত্র্যে সাজানো। এ রাষ্ট্রে জনগণমুখী শাসন ছাড়া কোনো রকম রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্য মানুষ মেনে নেয়নি, কখনো নেবেও না।
বিজয়ের আনন্দ সবচেয়ে আলাদা। সেই আনন্দ বর্ণিল ও গৌরবের। আমরা সেই সৌভাগ্যবান জাতির একটি, যাদের আছে বিজয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার দিন। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ সাধারণ কোনো দিন নয়। এদিন প্রথম শেকল ভেঙে উড়েছিল আমাদের মুক্তির পায়রা। বছরের পর বছর আমরা সেই আনন্দ বুকে লালন করে টিকিয়ে রেখেছি আমাদের অস্তিত্ব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে নিয়ে চলছে মুক্তিযুদ্ধের এ বিজয়ের পতাকা। একে তো সমুন্নত রাখতেই হবে আমাদের।
বিজয়ের দিনটিতে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করতে হবে। অগ্রগতির পথযাত্রায় এগিয়ে যেতে নতুন করে শপথ নিতে হবে। যার মাধ্যমে আমাদের জীবনে আসবে অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সুবিচারপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল যতো সব অর্জন- মিলবে অর্থনৈতিক মুক্তি।
শাহ মতিন টিপু: কবি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।