মো. সাখাওয়াত হোসেন
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক বার্ষিক সম্মাননা চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ মূলত পলিসি লিডারশিপ, বিজ্ঞান, ব্যবসা ও সুশীল সমাজ এ চার ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়ে থাকে। অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কারটি এ পর্যন্ত ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কার পেয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের কাছে এ অর্জনটি অত্যন্ত গৌরবের ও মর্যাদার।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের সমন্বয়ে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফোরামের কণ্ঠস্বর। ব্রিটেনের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড. জেন অ্যালান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো ব্যক্তি জলবায়ু সম্মেলনের মানবিক প্রতিচ্ছবি।
ইউএনইপি বলেছে, বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে নিজস্ব তহবিল দিয়ে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করেছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এ তহবিলে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, সংবিধানে জলাভূমি ও বন্য প্রাণী রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার গৃহীত বন নীতিমালা আবহাওয়ার বেশ কিছু চরমভাবাপন্ন অবস্থার প্রতিকার হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল পদক্ষেপের কারণেই বিশেষ করে শেখ হাসিনার ভিশনারি নেতৃত্বের প্রগাঢ়তায় ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি দায়ী ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে সিভিএফভুক্ত ৪৮টি দেশ।
ড. জেন অ্যালান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর নৈতিক ভিত্তি থাকায় তারা দাবিনামা পেশ করতে পারছে। শুধু তাই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জাতিসংঘের মাধ্যমে যুতসই চুক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে গ্লাসগো সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। সে লক্ষ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য বিশ্বনেতাদের সামনে চার-দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রথম দফা হচ্ছে- শিল্পোন্নত দেশগুলো যাতে তাদের কার্বন নি:সরনের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনে। দ্বিতীয় দফা হচ্ছে- ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড নিশ্চিত করে। তৃতীয় দফা হচ্ছে- উন্নত দেশগুলো যাতে কম খরচে এবং সহজে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে গ্রিন টেকনোলজি দেয়। চতুর্থ দফা হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং বন্যাসহ নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ইউএনইপি বলেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত বিনিয়োগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক অচিম স্টেইনার বলেন, বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনমূলক নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। তিনি আরও যোগ করেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন প্রণয়নসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করায় বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রস্তুত। জলবায়ু পরিবর্তনকে দেশে জাতীয় অগ্রাধিকারের অন্যতম ইস্যু এবং সেই সঙ্গে এ বিষয়ে বিশ্ব স¤প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে জোরালো ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত তুলে ধরে একটি কলাম লিখেন। তিনি তাঁর কলামে নানাবিধ বিষয় তুলে ধরেন এবং দেশ বিদেশে কলামটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ শক্তিশালী গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী অববাহিকার শেষ প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় এখানে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয় বেশি দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ফলে আহূত পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা ও ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর অভিমত সহকারে কলামটি লেখা হয়েছে। তাঁর লেখার পর্যালোচনায় তিনি সমস্যা তুলে ধরেন এভাবে- বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বর্ষার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে বৃষ্টিপাতের মাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং তার প্রভাবে নিয়মিত বন্যা দেখা দেয়। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার মারাত্মক হুমকিতে পড়ে, যা কৃষি উৎপাদন ব্যাহত এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে সংকটে ফেলে।
সমস্যা সমাধানের কৌশল হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন- জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাঙ্গীণ ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ প্রণয়নের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কৌশলগত বিনিয়োগে জার্মানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হল- নবায়নযোগ্য শক্তি, শক্তি-সঞ্চয় অবকাঠামো, পাওয়ার-গ্রিড আধুনিকীকরণ এবং নির্গমন নিয়ন্ত্রণ। এর আওতায় বাংলাদেশের শিল্প এবং অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর আর্থিক সুরক্ষার বিষয়েও নজর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক এবং প্রকৃতিভিত্তিক কৃষি ও মৎস্যসম্পদ, পরিবেশবান্ধব পরিবহন এবং সুস্বাস্থ্য কর্মসূচির বিকাশে ব্যবস্থা গ্রহণ।
গোটা বিশ্ব যখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ সরকারও ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কোভিড-১৯ সংকটের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, সীমিত ভূ-সম্পদ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রয়েছে। বাংলাদেশে বিগত ২০ বছরে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, ১৯৭১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ১০০টির বেশি উচ্চ-ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া খাদ্যের চাহিদা মেটাতে, সামাজিক চ্যালেঞ্জ প্রশমিত করতে এবং জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অনেক এলাকায় ভাসমান কৃষির চর্চা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সামুদ্রিক বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ এবং উপকূলীয় এলাকায় বৃক্ষরোপণ করেছে। সরকার গ্রিনবেল্ট উন্নয়ন ও বনায়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ১ কোটি ১৫ লাখের বেশি চারা রোপণ করেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সুন্দরবনের কার্বন সঞ্চয়ের ক্ষমতা স্থলজ বনের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের পথ অনুসরণ করছে, তবে এ যাত্রায় সব দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হবে একটি অংশীদারত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি এবং দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে সফল উদ্যোগগুলো থেকে পাওয়া শিক্ষা কাজে লাগানোর মাধ্যমে। একই সঙ্গে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে যেন পরিবর্তিত পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এমন দায়িত্বশীল আচরণের ইতিবাচক উদাহরণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদ আলেক্সান্ডার গোলুব ও এলেনা স্ট্রুকোভা গোলুবের অনুসন্ধানী গবেষণায় জানা যায়, ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো বন্যা ও অন্যান্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, তাই তাঁরা এসব অঞ্চলের সমস্যার সমাধানের ওপর বেশির জোর দিয়েছেন। তাদের গবেষণার ফলাফল হিসেবে তারা বেশ কিছু পরামর্শ প্রদান করেছেন তার মধ্যে প্রথমটি হল: ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণ। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণের পাশাপাশি পুনরায় বৃক্ষ রোপণ করতে পারে, যেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করবে।
তাদের দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হচ্ছে: আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা এবং আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে যেখানে মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। তৃতীয় সম্ভাব্য সমাধানটি হলো নিচু জমির চারপাশে বাঁধ দেওয়া, যা বন্যা থেকে কৃষিজমি, বাড়িঘর ও অবকাঠামোকে রক্ষা করবে। এদিকে বাংলাদেশ কিন্তু দুর্যোগ প্রশমন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট দক্ষতার সহিত জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে।
সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে, জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সরকার গৃহীত উদ্যোগকে স্বার্থক করে তুলতে দেশব্যাপী প্রচার প্রচারণা চালিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের নিমিত্তে কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে। ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্তে মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন ফোরামে নেতৃত্ব প্রদান করছে এবং অভ্যন্তরীনভাবে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আশা থাকবে, গ্রহণীয় পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং ভবিষ্যৎ নিরাপদ বিশ্বের স্বার্থে জনবান্ধব কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।