বড়দিন-আধ্যাত্মিকতা ও বাহ্যিকতা

শৌল বৈরাগী

আজ ২৫ ডিসেম্বর। বড়দিন বা যীশুর জন্মদিন। সময়ের বিবেচনায় হয়তো দিনটি অন্যান্য দিনের তুলনায় মোটেই বড় নয় বরং সৌর মন্ডলের হিসেবে ছোট দিনগুলোর মধ্যে একটি। কেননা ২৩ ডিসেম্বরকে বলা হয় সবচেয়ে ছোট দিন। সে হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর দিন হিসেবে বা সময়ের বিবেচনায় ছোটই বটে। তবুও ২৫ ডিসেম্বর খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসীদের নিকট বড়দিন হিসেবেই বিশ্বে পরিচিত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দিনটি অনেক বড় তাৎপর্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।

দু’হাজার বছর আগে মানুষের মুক্তির জন্য ইস্রায়েল দেশের যুদেয়া প্রদেশের বেহলেহেম নগরে জন্ম নিয়েছিলেন পৃথিবীর মানুষের পাপের মুক্তিদাতা হিসেবে ত্রাণকর্তা প্রভু যীশুখ্রীষ্ট। মুক্তিদাতা হিসেবে তিনি ঈশ্বর হয়েও মানুষ রূপে পৃথিবীতে এসেছেন। একজন মানুষ যখন ঈশ্বর হয়েও পৃথিবীতে এলেন, মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিলেন, মানুষের কাছে ত্রাণকর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন, ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে একটা ঐশ যোগাযোগ স্থাপন করলেন- এসব বিষয়গুলো বিবেচনা ও গুরুত্ব বিবেচনা করেই দিনটি কে বড়দিন হিসেবে বিশ্বে পরিচিত এবং আত্মিক দিক দিয়ে তো বটেই একটি বড়দিন বা ঘটনা। যীশুখ্রীষ্ট প্রচার এবং কাজের মাধ্যমে মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তিনি ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং মানুষ নিজেদের পাপের পথ পরিহার করে ঈশ্বরের পথে এসেছেন। করেছেন আত্মিক ভাবে সমৃদ্ধ।

বাংলায় বড়দিন এবং ইংরেজীতে বলা হয় ক্রিসমাস। যে ভাষাতে যাই বলা হোক না কেন অর্থ কিন্তু একই। কবে কোথায় থেকে বড়দিন বা ক্রিসমাস শব্দের উৎপত্তি সে আলোচনা না হয় পরে করা যাবে। আজ বড়দিন কিভাবে পালন করা হয় এবং এর সংস্কৃতি রীতিনীতি কি সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা। বড়দিন পালনের মান্ডলিক এবং ধর্মীয় নিয়ম বা নির্দেশনাগুলো কিন্তু প্রায় সব দেশে এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে প্রায় একই। অর্থাৎ মান্ডলিক বা ধর্মীয় কিছু নিয়ম-কানুন আছে তা সবাই সমভাবে এবং আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির জন্য সবাই পালন করে থাকেন।

যেমন উল্লেখ করা যায়, ক্যাথলিক মন্ডলীতে বড়দিন’র ৪ (চার) সপ্তাহ পূর্ব থেকে বড়দিন বা যীশুর জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু করে, নভেনা করা হয়, পাপ স্বীকারসহ অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানগুলো করা হয়। একইভাবে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী সকল মন্ডলীতেই আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বা প্রত্যেকের হৃদয়ে যেন যীশু জন্ম নিতে বা আসন গ্রহণ করতে পারেন এমনই রীতিনীতি পালন করে থাকে। সকল খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্য একটাই ব্যক্তি, সামাজিক ও গোষ্ঠীগতভাবে যেন সবাই আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ হয়, যীশু যেন প্রত্যেকের হৃদয়ে বরণ ও ধারণ করতে পারেন। নিজের অতীত জীবনের ভুল, ত্রুটি ও পাপময় জীবন থেকে যেন ফিরে আসতে পারে। এগুলোর সাথে সাথে খ্রীষ্টভক্ত স্বতঃস্ফুর্তভাবে যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বারতা যেন সবাই জানতে ও বুঝতে পারে তার জন্য পাড়ায় পাড়য়, মহল্লায় মহল্লায় কীর্তন’র আয়োজন করে থাকে। বয়স অনুসারে কখনো কখনো নারী পুরুষ আলাদা দলে আবার কখনো একই সঙ্গে কীর্তন গানের মাধ্যমে যীশুর জন্ম বার্তা সকল মানুষের মধ্যে প্রচার করে থাকে।

বড়দিনে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির সাথে থাকে বেশ কিছু বাহ্যিক প্রস্তুতি যা চোখে পড়ার মত। এত যে আয়োজন থাকে যা বড়দিনের আনন্দে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে এবং সবাইকে একই সূত্রে নিয়ে আসে। এগুলোর মধ্যে প্রথমেই যা উল্লেখযোগ্য তা হলো বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য কার্ড। পরিবার, পরিজন, দূর-নিকট বন্ধু বান্ধব, পরিচিতজনদের মধ্যে বড়দিনের বিভিন্ন ডিজাইনের, আকারের, আকৃতির কার্ড একে অন্যের মধ্যে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। বর্তমান যুগে ও টেকনোলজির বদৌলতে এখন ভার্চুয়াল শুভেচ্ছাই বেশী বিনিময় করে থাকে। কার্ডের মতই কেক কাটা ও খাওয়া বিষয়টিও জাতি, দেশ ও সংস্কৃতি হিসেবে সবাই করে থাকেন। সাজানো হয় প্রতীকি গোসালা ঘর। বড়দিনে সান্তাক্লজ বা ক্রিসমাস ফাদারের আগমন ও শিশুদের সাথে সময় কাটানো ও উপহার বিতরণও (প্রতীকী) প্রায় সবদেশে ও সকল মন্ডলীতে হয়ে থাকে। তবে এটি বিশেষ আয়োজন বিধায় এবং বেশ খরচেরও ব্যাপার বলে এখনও সব খ্রীষ্টভক্তদের মধ্যে পালিত হয় না। কিছুটা সীমিত ও স্বচ্ছল দেশ ও এলাকগুলোতে এবং বিভিন্ন হোটেলগুলোতে বিশেষ ব্যবহস্থাপণায় আয়োজন করে আনন্দ ও বিশেষভাবে শিশুদের মধ্যে চকলেট ও বিশেষ উপহার দিয়ে থাকে। এত সবের পাশাপাশি পোষাক-পরিচ্ছদ, গহণাসহ উপহারও নিজেদের ও পরিচিতজনদের জন্য কিনে থাকেন।

উন্নত দেশগুলোতে বড়দিনের এক মাস পূর্ব থেকেই এসব প্রস্তুতি শুরু হয়ে থাকে। সবাই নতুন নতুন ও বিচিত্র পোষাক পরে আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যীশুর আগমন বার্তা প্রচারের জন্য বড়দিনের কয়েকদিন আগে থেকেই পাড়া, গ্রাম, মহল্লায় ছেলে, মেয়ে, যুবক এমনকি বয়স্করা কীর্তন গান করে তা সব ধরণের জনগণকে জানান দেন। কীর্তন চলে সারা রাত। বড়দিন একটি মিলন মেলা। এ সময়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে আত্মর যোগাযোগের সাথে বাহ্যিক যোগাযোগ হয়ে থাকে। পারিবারিক সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের একটি মিলন মেলা হয়ে থাকে। চার্চগুলো এবং প্রতিটি খ্রীষ্টভক্তদের বাড়ী বিভিন্ন লাইট, তারা ও অন্যন্য সু-দৃশ্য সাজানো বস্তু এবং সাথে সাথ্যমত ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে সু-সজ্জিত করা হয়। এছাড়া বাড়ী বাড়ী, ঘরে ঘরে পিঠা, পায়েস তৈরী করে থাকে এবং বিতরণ করে। যা মানুষের মধ্যে আত্মিক ও বাহ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে থাকে। বর্তমানে অনেক স্থানেই প্রাক-বড়দিন পালন করা হয়।

২৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকেই চার্চগুলোতে বড়দিনের উপাসনা শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে বৈশি^ক কিছু সামাজিক ও নিরাপত্তজনিত কারনে চার্চগুলোতে সন্ধ্যা রাতেই উপসনা শেষ করা হয়। কিন্তু পূর্বে চার্চগুলোতে উপাসনা শুরু হতো ঠিক রাত ১২টার পরে অর্থাৎ ২৫ তারিখ প্রথম প্রহরে। ২৫ তারিখ সকালেও প্রতিটি চার্চে উপসনা হয়ে থাকে, সাথে থাকে মেলা। মেলা সারাদিন এমনকি কোথাও কোথাও বড়দিন পরবর্তী অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর পরবর্তী ২/৩ দিন পর্যন্ত চলে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই একাকার হয়ে যায়। কে কোন ধর্মের, কে কোন জাতির বা গোষ্ঠীর মানুষ তা ভুলে সবাই একাকার হয়ে যায় একই মিলন বন্ধনে।

আরো একটি সংস্কৃতি কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে যে, বড়দিনের দিনে মন্ডলীর সকল খ্রীষ্টভক্তগণ নিজেরা পরিবারের সদস্য অনুযায়ী চাঁদা দিয়ে একসঙ্গে রান্না করে ভোজন করে থাকে। কোন কোন এলাকার একে প্রেমভোজ নামে অভিহিত করা হয়। আর বড়দিনের আদর্শ ও আধ্যাত্মিকতা এখানেই বিরাজমান। সবকিছু বিবেচনা করে একটি বিষয়ই বড়দিনে ফুটে উঠে, তা হলো বড়দিন মানে মিলন, বড়দিন মানে একাত্মতা, বড়দিন মানে শান্তি, বড়দিন মানে নিজেকে পরিবর্তন, বড়দিন মানে ঈশ্বরের সাথে নিজের সম্পর্ক দৃঢ়করণ। কেননা যীশুর জন্মের পরে রাখলদের নিকট উপস্থিত হলো এই বানী নিয়ে, ‘পরে হঠাৎ স্বর্গীয় বাহিনীর এক বৃহৎ দল ঐ দূতের সঙ্গী হইয়া ঈশ্বরের স্তব গান করিতে কহিতে লাগিলেন, উর্ধলোকে ঈশ^রের মহিমা, পৃথিবীতে (তাঁহার) প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি।’ (লূকঃ ২ঃ১৩-১৪ পদ)।

আজ এই বড়দিনে ‘শান্তি’ নিয়ে দু’একটি কথা না বললেই নয়। যে শান্তি যীশুখ্রীষ্ট পৃথিবীতে স্বর্গ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই শান্তি কি আজ পৃথিবীতে বিরাজমান? আমরা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি বা হালকাভাবেও ভাবি তবে কিন্তু ষ্পষ্ট যে পৃথিবীতে আজ শান্তি’র বড় অভাব। দেশে দেশে যুদ্ধ, আবার কেউ কেউ যুদ্ধকে উসকে দেয়, কারো কারো অস্ত্র বিক্রি করার লক্ষ্যে বিবাদ টিকিয়ে রাখা, কোন কোন অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে রাখা, জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, রাজনৈতিক অনৈক্য ও মৌলিক বিষয়ে মতবিরোধ, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে হানাহানি, মারামারি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি আজ সর্বময় দেখা যায়। অশান্তির ডামাডোল সর্বখানে বিরাজমান। আজ আমাদের ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে ‘বড়দিন আমার নিজের মধ্যে কি প্রভাব করতে পেরেছে, আমার নিজের এবং চারিপাশের মানুষের মধ্যে কতটা শান্তি এবং যীশুখ্রীষ্টের আদর্শ বজায় রাখতে পারছি।

আজ এই বড়দিন নিজেকে নিয়ে ভাবার দিন, নিজেকে মূল্যায়নের দিন, নিজের পরিবর্তনের দিন। তাই, আসুন, যীশুখ্রীষ্ট যে শান্তি স্বর্গ থেকে পৃথিবীনে নিয়ে এসেছেন, সে শান্তি প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিষ্ঠিত করায় নিজেকে সমর্পন করি। সবার মধ্যে শান্তি বিরাজমান থাকুক। সবাইকে শুভ বড়দিন।

শৌল বৈরাগী:লেখক ও কলামিষ্ট

Print Friendly

Related Posts