ভাতৃত্বের বন্ধনের শিক্ষায় পবিত্র ঈদুল ফিতর

অলোক আচার্য

’ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ
তোর সোনাদানা,বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত,মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় এ গানেই ঈদ-উল-ফিতরের মহিমা ষ্পষ্ট। আনন্দের সাথে সাথে ঈদ যে নিজেকে অন্যের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার, ভালোবাসার এবং বুকে বুক মিলিয়ে একত্রিত হবার দিন সে কথাই জানান দেয় এই গানে।

রমজান মাসের চাঁদ দেখার মধ্যে দিয়ে রোজা রাখা শুরু হয়। এই একটি মাস নিজের ভেতরের সব অহংকার, বদভ্যাস দম করার মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধ করে গড়ে তোলেন। এই মাস মূলত আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ, উদারতা, মহানুভবতা প্রভৃতি গুণের সমন্বয় ঘটানোর মাস। সবাই মিলে একসাথে সারা দিনের রোজা শেষে ইফতারি করার যে ভাতৃত্বপূর্ণ দৃশ্য দেখা যায় তা অতুলনীয়। তারপর একমাস রোজা শেষে আসে ঈদের খুশি।

আসলে ঈদ মানেই খুশি। সবার মাঝেই এই আনন্দ বিরাজ করবে। দেশজুড়ে সবাই ব্যস্ত কেনাকাটায়। বাবা-মা তার সন্তানের জন্য পছন্দের এক বা একাধিক পোশাক কিনতে ব্যস্ত। যাদের নুন্যতম সামর্থ্য আছে তারাই দোকানে যায় পোশাক কিনতে। কিন্তু যাদের একেবারেই কেনার সামর্থ্য নেই বা অভিভাবকহীন তাদের অবস্থা ভাবা দরকার। আবার পছন্দের পোশাকের দাম বেশি হলে অভিভাবকের আয়ত্বে থাকে না। তাছাড়া গত দুই বছরে করোনার কারণে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ বেড়েছে। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অন্যদিকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণেও মানুষের আর্থিক সক্ষমতায় আঘাত এসেছে। তবুও সবাই সামর্থ্যমতো আনন্দ উদযাপনের চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।

ঈদের আগে খুশি মন থাকলে কয়েকটি খবর পত্রিকায় পড়ে বেশ হতাশ হতে হয়। যার একটি হলো ঈদে পোশাক কিনতে না পেরে আত্মহত্যার মতো খবর। পাবনার সাঁথিয়ায় তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ঈদের জামা কিনে না দেওয়ায় বাবার ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে।এরকম সামর্থ্যহীন শিশু বা অভিভাবকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দেশে অনেক মানবিক সংগঠন রয়েছে যারা ঈদের অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছে। রমজানের শুরু থেকেই এসব সংগঠন এতিম ও অসহায়দের পাশে থাকে। এর মধ্যেই এ ধরনের দু’একটি ঘটনা মনে দাগ কাটে।

ঈদ সবার জন্য। ঈদ সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে আনন্দ করা। ঈদ মানে মানবতা। একটি শিক্ষা। সেই শিক্ষা মহত্বের। মানবতার। কেউ কেউ হয়তো নতুন পোশাক কিনতেও পারবে না। বিশেষ করে রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশুগুলো। যাদের তিনবেলা খাওয়ারই নিশ্চয়তা নেই। যারা দিনের বেশিরভাগ সময়ই খালি গায়ে থাকে। যারা তীব্র শীতে ফুটপাতে চটের বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমায়। ওরা কিভাবে নতুন পোশাক কিনবে? বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখা মেলে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল,স্বল্পন্নোত বা অনুন্নত দেশগুলোতে এদের দেখা বেশি মেলে। আমাদের দেশেও চারদিকে তাকালেই এধরনের শিশুর দেখা মেলে। রাস্তা,ফুটপাত যাদের ঠিকানা।

বড়লোকের আহ্লাদে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের পাশাপাশি এরাও বড় হয়। অভাব যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী। খোলা আকাশ যাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে থাকে। আবার ঈদের দিনেও রাস্তায় বহু নিঃস্ব সহায়-সম্বলহীন মানুষের দেখা পাওয়া যায়। যদি এদের কষ্ট দূর করা যায় অর্থাৎ তাদের জন্য স্থায়ী কোনো সমাধান করা যায় তাহলে ঈদের আনন্দ আরও বেড়ে যাবে। ঈদে তাদের পাশে দাড়ানোও একটি নির্মল আনন্দের বিষয়। কারণ ঈদ আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়। রমজান মাসের পুরো সময় ধরেই বিভিন্ন এতিম শিশুদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন অনেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি,সংগঠন।

এই যে অসহায় মানুষের মনে হাসি ফোটানোর প্রচেষ্টা এটা আমাদের সমাজে সামর্থ্যবান মানুষেরাও করতে পারে। যার যার অবস্থান থেকে মানুষের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এই শিক্ষা আমাদের মর্মকুটিরে পৌঁছাতে হবে। ঈদ ভাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করে। সাম্যের চেতনা ধারণকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঈদুল ফিতরের মর্মবাণীকে তার কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার ঈদ মোবারোক কবিতায় তিনি লিখেছেন,

’ ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সবাই
নাই অধিকার সঞ্চয়ের। কারো আঁখি জলে
কারো ঝাড়ে ফিরে জ¦লিবে দ্বীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ নসীব,লাখে লাখে হবে বদনসীব?
এ নহে বিধান ইসলামের।”

আদিকাল থেকেই বাংলাদেশ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মিলে মিশে সবার বসবাস। মুসলিম প্রধান পর্ব দুটি ঈদ, হিন্দুদের দূর্গাপূজা, খ্রিষ্টানদের বড় দিন এবং বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা। যার যার ধর্মীয় আচার তারা পালন করে। আনন্দ ছড়িয়ে পরে সারা বাংলায়। আমরা সবাই বাঙালি। তাই আনন্দটা সবার মুখেই হাসি এনে দেয়। একজনের আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার হয়। এসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করা এবং তার মহিমা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সম্প্রীতির রীতি। দেশে শান্তি এবং সহমর্মিতা বিরাজ করে। মানুষে মানুষে আজ যে হানাহানি, মারামারি বা সংঘাত,আজ মানুষের মনে জায়গা করেছে হিংসা,ক্রোধ, মানুষের মন আজ ভরে গেছে অহংকারের কাঁদায়, সেসব মুছে দিয়ে সেখানে শান্তির বাণী, সঠিক পথের দিশা দেখাতেই আসে পবিত্র এ মুহূর্ত। ধনী-গরীব এক কাতারে দাাড়িয়ে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সমপর্ণ করে।

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর প্রতি বছর যে মনুষ্যত্ব, মমত্ববোধ, বৈষম্যহীনতা এবং সহনশীলতার বার্তা নিয়ে আসে তা ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে উঠুক সোনার বাংলা।

অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক, পাবনা।

ইমেইলঃ sopnil.roy@gmail.com

Print Friendly

Related Posts