বেঁচে আছেন কিসিঞ্জার, পা রেখেছেন শতবর্ষে

শাহ মতিন টিপু

হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন কূটনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। বড় বড় সফলতা আর ‘অগণিত’ বিতর্কিত রেকর্ডসহ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন দেশে, দুর্নামও তেমন জুটেছে বিদেশে। পুরস্কার-তিরস্কার দুইই আছে তার স্বর্ণোজ্জ্বল রাজনীতিক জীবনে। ঘৃণা-প্রশংসার দ্বৈরথে শনিবার (২৭ মে) শতবর্ষে পা রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের সদাহাস্য চেহারার এই কূটনীতিক।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটি মিশনে গোপনে বেইজিংয়ে যান কিসিঞ্জার। যাওয়ার পর তিনি সেখানে নিক্সনের একটি যুগান্তকারী সফরের মঞ্চ তৈরি করেন। তৎকালীন বিচ্ছিন্ন বেইজিং আর উৎপাদন শক্তি আর যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে চীনের উত্থানে অবদান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। চীন ছাড়ার সময় কিসিঞ্জার চীনকে ব্যবসায়িক পরামর্শসহ মার্কিন নীতির বিষয়ে কটূক্তিতে সতর্ক করেছিলেন।

ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধকে ‘সম্মানের সঙ্গে’ শেষ করতে নিক্সনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। লাওস-হ্যানয়ের সরবরাহ লাইন বন্ধ করতে গোপনে প্রতিবেশী কম্বোডিয়ায় বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। সে সময় কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক মারা গিয়েছিল বলে অনুমান করেন কিছু ইতিহাসবিদ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখোমুখি দাঁড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়ায় চিলি আর আর্জেন্টিনার মতো বাম সরকারগুলোকে উৎখাতের পক্ষে ছিলেন কিসিঞ্জার। একটি স্মারকলিপিতে দেখা যায়, চিলির সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের মতো একটি বামপন্থি নির্বাচিত সরকার কাজ করতে পারে তা দেখিয়ে একটি ‘প্রতারণাপূর্ণ’ মডেলের প্রস্তাব করেছিলেন কিসিঞ্জার। সিআইএ-সমর্থিত অভুত্থ্যানে সৈন্যরা দায়িত্ব নেওয়ার পর আলেন্দে আত্মহত্যা করেন।

কূটনীতিতে কিসিঞ্জার তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর আকস্মিক আক্রমণ শুরুর পর মিত্র ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহে বড় ধরনের একটি কৌশলগত এয়ারলিফট পরিচালনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মস্কোকে দমাতে কিসিঞ্জার সবচেয়ে জনবহুল আরব দেশ মিসরের সাথেও সম্পর্ক পরিবর্তন করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের শততম জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে চীন। শুক্রবার কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত জি ফেং। খবর: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’র।

যুক্তরাষ্ট্রে চীনা দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও দ্বিপাক্ষিক আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে জি ফেং ও হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যে গভীর আলোচনা হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের তিন দিন পরই কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের কেন্ট শহরে হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করেন চীনের সাবেক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি ফেং। কোথায় দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে তা বিবৃতিতে বলা হয়নি। তবে কেন্ট শহরে কিসিঞ্জারের একটি বড়সড় বাসভবন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের কেন্ট শহরে হেনরি কিসিঞ্জারের (ডানে) সঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূত জি ফেং

শনিবার ১০০ বছরে পা রাখা ঝানু কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের ক্যারিয়ারজুড়ে চীনের বড় জায়গা রয়েছে। কিসিঞ্জারের অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্তরের দশকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধ নিরসনে ব্যাপক মাত্রায় ভূমিকা রেখেছিল। এরপর থেকেই চীনের বাঘা বাঘা নেতাদের সঙ্গে এবং জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। গত সেপ্টেম্বরেও নিউইয়র্কে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি’র সঙ্গে বৈঠক করেন কিসিঞ্জার।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের দিক নির্দেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে।১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, একটি তলাবিহীন ঝুড়ি।বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলায় বাঙালিরা বরাবরই হেনরি কিসিঞ্জারের উপর ক্ষিপ্ত।

শওকত হোসেন, ৭ মার্চ ২০২১ ‌‘তলাবিহীন ঝুড়ি কথাটি যেভাবে বাংলাদেশের হয়েছিল’ শিরোনামে এক নিবন্ধে প্রথম আলোতে লিখেন- হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে বাংলাদেশের একদল সাংবাদিকের দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালে, সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেই সাংবাদিক দলে আমিও ছিলাম। সম্মেলনের প্রথম দিন। মাত্রই সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছেছি, ঢুকেই দেখি দাঁড়িয়ে চেরি ব্লেয়ার, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী। হঠাৎ দেখি বার্তা সংস্থা ইউএনবির শামীম আহমেদ (বর্তমানে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার) উল্টো দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। লিফটের ঠিক সামনে তখন হেনরি কিসিঞ্জার। সুযোগটি ছাড়লেন না শামীম আহমেদ। সামনে দাঁড়িয়েই হেনরি কিসিঞ্জারকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘বাংলাদেশকে মনে আছে আপনার? সেই যে আপনি বাস্কেট কেস বলেছিলেন। এখন কী বলবেন?’ প্রশ্নটি শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে কিসিঞ্জার উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিশেষ এক সময়ের পরিস্থিতিতে এ কথা বলেছিলাম। এখন আর সে বিষয়ে কোনো কিছু বলতে চাই না।’

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ রাজধানীর জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি মিলনায়তনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ শীর্ষক লোকবক্তৃতা অনুষ্ঠানে সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী বা খুনিদের বিচার হয়েছে; কিন্তু এর কুশীলব, মাস্টারমাইন্ড কে বা কারা? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ সময় তিনি তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জারের অবস্থান ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করছি যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরিকল্পনাকারী হিসেবে কিসিঞ্জারে বিরুদ্ধে পৃথিবীর কোথাও মামলা করা যায় কি না। খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি করা নাকি যায় না, এ জন্য রাষ্ট্রের কী কী যেন….দরকার হয়।

কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টারমাইন্ড কি না এ জন্য এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাবির এই অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাক যখন ক্ষমতায় এলো তখন তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সময় বলেছিলেন যে, আমার কূটনৈতিক জীবনে কোনো দেশকে স্বীকৃতি দিতে এত আনন্দিত কখনো হইনি, যা এখন (বাংলাদেশকে স্বীকৃতি) হচ্ছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সব সময় শোষিত মানুষের কথা বলেছেন। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলেছেন। গায়ের জোরে কোনো এলাকা দখলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি নিরন্তর গণতন্ত্র, ফ্রিডম, জাস্টিসের কথা বলেছেন। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছিলেন। তাকে হত্যার কারণে দেশের উন্নয়ন পিছিয়েছে তা নয়। আমি বলব, বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডাক থো যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। জানুয়ারি, ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধ বিরতি এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু ভিয়েতনামের বিপ্লবী, জেনারেল, কূটনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লে ডাক থো পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান কেননা তখনো যুদ্ধ চলছিল।কিন্তু তাদেরকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের ফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। এরফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুইজন সদস্য পদত্যাগ করেন। কিন্তু যখন এ পুরস্কারের বিষয়টি ঘোষিত হয়, তখনও উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত ছিল।অনেক সমালোচকদের অভিমত, কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিশিষ্ট অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘কিসিঞ্জার বাংলাদেশের গণহত্যাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। তাই আমি কিসিঞ্জারের প্রশংসা করার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। ভিয়েতনামসহ অন্য অনেক দেশে একই মতামত বিশ্বাস করা হয় বলেও জানান তিনি।

 

Print Friendly

Related Posts